*** লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
*** উদ্যানে বর্তমানে কতসংখ্যক প্রাণী আছে, নেই সঠিক তথ্য
*** অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনা, গাছ-বাঁশ উজাড়, বনের ভেতরে রেলসহ বিভিন্ন কারণে কমে গেছে প্রাণীর অবাধ বিচরণ
দেশের অন্যতম জাতীয় উদ্যান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। আগত পর্যটকদের অবাধ বিচরণ ও উদ্যানের ভেতর লাউয়াছড়ায় গুটি কয়েক বানর ছাড়া আর আগের মতো বন্যপ্রাণীরা অবাধ বিচরণ করছে না। একসময় উদ্যানটি ছিল বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। জাতীয় উদ্যানের ভেতর ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। সম্প্রতি অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনা, চুরি করে গাছ-বাঁশ উজাড় করা, বনের ভেতরে রেল, সড়কপথ থাকাসহ বিভিন্ন কারণে প্রাণীর অবাধ বিচরণ কমে গেছে। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ বনবিভাগ।
এদিকে, লাউয়াছড়া উদ্যানে বর্তমানে কতসংখ্যক প্রাণী রয়েছে, তারও সঠিক তথ্য নেই বনপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (ওয়াইল্ড লাইফ) কাছে। তবে ২০১৪ সালের একটি জরিপে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল এ উদ্যানে। এ ছাড়া বনবিভাগ জানে না, এই সংরক্ষিত বনে কতটুকু জায়গা রয়েছে?
কাগজে-কলমে উদ্যানটির আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর লেখা থাকলেও নেই চারদিকের সীমানাপ্রাচীর। বনের পাশে যাদের বাড়িঘর ও জমি রয়েছে। এ বন সংলগ্ন এক শ্রেণির প্রভাবশালীরা অনেকে বনের জমি দখল করে রেখেছে। অনেকে আবার দখল করে গড়েছে লেবু বাগান। এর মাঝে জমি উদ্ধার অভিযান হলেও সীমানাচিহ্ন না থাকায় বাধাগ্রস্ত হয় উদ্ধার কাজ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটক প্রবেশ করেছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮১২ জন। দেড় বছর করোনার বন্ধ ছিল। ২০২৩-২০২৪ সালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৬৭২। সবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৫ জন পর্যটক টিকিট কেটে উদ্যানে প্রবেশ করেছেন।
বন বিভাগ (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) বলছে, বনে প্রাণীর সংখ্যা কমেনি। বন্যপ্রাণী, পাখি, শূকরসহ বিভিন্ন প্রাণী বেড়েছে। দিনের বেলায় প্রাণী দেখা না গেলেও ভোরে দেখা যায়। অতিরিক্ত পর্যটকের হট্টগোল, গাড়ি ও ট্রেনের আওয়াজ এবং জনসংখ্যা বাড়ার কারণে প্রাণীরা লোকালয় থেকে একটু দূরে চলে যায়। এসব কারণে প্রাণী কম দেখা যায় বনে। তবে বনবিভাগ স্বীকার করে জানায় পর্যটন আর বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ একসঙ্গে রক্ষা করা কঠিন।
সরেজমিন দেখা যায়, শুধু কিছু বানর উদ্যানের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক পর্যটক বানরের দলকে বিভিন্ন খাবার দিচ্ছেন। এ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী দেখা যায়নি। বনের ভেতরে সড়কপথে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল এবং রেলপথে ট্রেন চলাচলের কারণে সব সময় একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ থাকে। প্রযই সড়ক অতিক্রম করাকালে বানর, সাপসহ বিভিন্ন জাতের প্রাণী গাড়িচাপায় মারা যায়। তাই প্রাণীরা থাকলেও প্রাণ ভয়ে তারা গভীর বনে চলে যায় বলে খুব একটা দেখা মেলে না।
স্থানীয়রা বলেন, একটা সময়ে এই বনের ঘনত্বের কারণে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ত না। এখন সেই ঘনত্ব নেই। আগে বনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বন্যপ্রাণী দেখা গেলেও এখন বানর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বনের প্রাণী কমে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোও অবাধে বিচরণ করতে পারছে না। বন ও বনের প্রাণী রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি সালেহ সোহেল বলেন, ‘লাউয়াছড়ায় প্রাণীরা এখন নিরাপদ নয়, এ জন্য কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বনে খাবারের সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত খাবার না থাকলে বনে প্রাণীরা থাকবে না। চা-বাগানের কীটনাশক মেশানো পানি ছড়ায় এসে পড়ে, এ জন্য অনেক প্রাণী মারা যায়। এগুলো বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া পর্যটক প্রবেশ কমাতে হবে। রেল ও সড়কপথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, তাহলে যেসব প্রাণী আছে, সেগুলো রক্ষা করা যাবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘লাউয়াছড়া বনে বানর ও শূকর প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে। অন্যান্য প্রাণী বেড়েছে না কমেছে, সে বিষয়ে গবেষণা ও জরিপ করলে জানা যাবে।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, ‘বন্যপ্রাণীর নিরাপদে চলাচলের জন্য বনবিভাগ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে এখন বনে প্রাণী কম দেখা যায়। এ ছাড়া উদ্যানের সীমানা নির্ধারণের জন্য সেটেলমেন্ট অফিসে চিঠি পাঠিয়েছি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন