শুক্রবার, ০৪ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৫, ০৩:১২ পিএম

জৌলুস হারিয়ে ধুঁকছে চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প

চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৫, ০৩:১২ পিএম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজশাহীর চারঘাট খয়ের শিল্পের জন্য সারাদেশে পরিচিতি লাভ করেও সেই ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্প বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে খয়ের উৎপাদনের একমাত্র প্রসিদ্ধ স্থান রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা। প্রয়োজনীয় উপকরনের মুল্য বৃদ্ধি এবং উপকরনের অভাবে সেই খয়ের শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। চারঘাটের উৎপাদিত খয়ের দিয়ে প্রায় সারা দেশে পান খাওয়া চলতো। শুধু তাই নয়, এই খয়ের থেকে তৈরী হয় খয়েরী রং। খয়ের প্রধানত খাদ্য হিসেবে পানের সাথে ব্যবহৃত হলেও রঙ, ওষুধ, কেমিক্যাল প্রভৃতি তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। খয়েরের বৈজ্ঞানিক নাম ‘একাচিয়া ক্যাটেচু’। খয়ের শিল্পের কাঁচামাল খয়ের গাছ।

এলাকার প্রবীন ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, ১৯৪৭সালে মুন্সী নুরুল হকের উদ্যোগে চারঘাটে খয়ের শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে ভারত থেকে আগত বিহারীদের মাধ্যমে এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটে। তারা আরো জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই খয়ের শিল্পের উৎপত্তি স্থল। তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান চারঘাট থেকে খয়েরের উৎপাদন শুরু হলে এখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর করাচীসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে রপ্তানী হতো। আর এর কদরও ছিল তখন ভীষণ। খয়ের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় খয়ের গাছ বর্তমানে খুবই কম।

কিন্তু চারঘাটের এই খয়ের শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য চারঘাটের তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মরহুম ডঃ নুর ইসলাম ইউসুফপুর পদ্মার চরে প্রায় ২০ হাজার খয়ের গাছের চারা রোপন করেন। এর পর থেকে সরকারি ভাবে কোনো খয়ের গাছ লাগানো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রথমে খয়ের গাছের উপরের চামড়া (ছাল) তুলে ফেলা হয়। তারপর গাছটি কুচি কুচি করে কেটে মাটির পাতিলে করে বিশেষ চুলোতে জাল (ফুটিয়ে) করে রস বের করে নেয়া হয়।

এরপর বড় ড্রামে করে রস জাল করে গাঢ় করা হয়। বড় মাটির পাতিলে ঢেলে রাখলে তা জমে যায়। যাকে বলা হয়, লালী খয়ের বা কাচা খয়ের। এই লালী খয়ের একমাত্র চারঘাটের হাটে কেনা-বেচা হয়ে থাকে। যা বাংলাদেশের আর কোথাও কেনা-বেচা হয় না। স্থানীয় খয়ের ব্যবসায়ীরা এই লালী খয়ের ক্রয় করে পূর্ণরায় আগুনে জাল করে। একটু ঠান্ডা হলে মেশিনের সাহায্যে চাপ দিলে বের হয়, চার কোণা আকৃতি খয়ের। গুটি করে কেটে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঠান্ড স্থানে শুকাতে হয়।

কারন-রোদে শুকালে খয়েরের দানা নষ্ট হয়ে যায়। খয়েরের গুটি শুকাতে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগে, গুটি শুকানোর পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা গুটি খয়ের ঢাকা, খুলনা যশোর রংপুর সৈয়দপুর জামালপর শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তাণী করে থাকেন। তবে অনেক ব্যবসায়ীরা আড়ৎদারদের কাছ থেকে খয়েরের টাকা ঠিক সময় না পাওয়ার কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়ে যায়। আবার অনেক ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে খয়ের টাকা বাকী পড়ে যাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে।

চারঘাট খয়ের ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করলে তারা দুঃখ করে বলেন, প্রায় ৪০/৫০ বছর থেকে আমরা এই খয়ের ব্যবসার সাথে জড়িত। আগের মতো এখন আর খয়ের ব্যবসা তেমন লাভ নেই। বর্তমানে চারঘাটের এই ঐতিহ্যবাহী খয়ের ব্যবসায় চরম মন্দাভাব চলছে। এই ব্যবসায় অনেক সময় বিভিন্ন মোকামে টাকা পড়ে থাকে। এ কারণে খয়ের ব্যবসায় তিন গুন টাকার প্রয়োজন হয়।

স্থানীয় খয়ের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমানে চারঘাটে কাচা লালী খয়ের ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ এবং শুকনা গুটি খয়ের থেকে ৩০ হাজার টাকা মণ মুল্য বেচা-কেনা হচ্ছে। চারঘাটের বিশিষ্ট খয়ের ব্যবসায়ী আব্বাস আলি শেখ জানান, তার বাবা মৃত ওমর আলি শেখ দীর্ঘ দিন থেকে এই খয়ের ব্যবসা চালিয়ে এসেছি। আর ব্যবসার ক্ষতি হলেও বাবার ব্যবসাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। আগে বিভিন্ন এলাকায় অনেক খয়ের গাছ হতো কিন্তু এখন এই খয়ের গাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে।

বিগত শতাব্দীর ষাট, সত্তর ও আশির দশক ছিল খয়ের শিল্পের সুবর্ণ সময়। সেই সময় চারঘাটের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ খয়ের শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু নব্বই-এর দশকের প্রথম দিক থেকে নানা কারণে এই শিল্পে ধস নামতে শুরু হয়। খয়ের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হন এবং ১৯৯৫ সালে ‘চারঘাট বাজার খয়ের ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি’ গঠন করেন। পরে চারঘাট পৌরসভা খয়ের ব্যবসায়ী সমিতি নামে আরেকটি সমিতি গঠিত হয়। তারপরেও খয়ের ব্যবসায় টিকে থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে চারঘাটের শনিবার ও বুধবার সপ্তাহে ২ দিন চারঘাটের হাটে এই খয়ের গাছ কেনা-বেচা হয়। খয়ের ব্যবসায় যেমন এখন আগের তুলনায় লাভ কমেগেছে তেমনি এখন খয়ের গাছ না পওয়ায় এই খয়ের গাছও কিনতে হচ্ছে দ্বিগুন দামে। দেশের ভেতর একমাত্র চারঘাটের খয়ের গুলি ভেজাল ছাড়া। বাকি দেশের বিভিন্ন স্থানে যে খয়ের পাওয়া যায় সেগুলি কেমিক্যালযুক্ত দিয়ে তৈরি করা খয়ের। চারঘাটের খয়ের ব্যবসায়ীরা এখানকার ঐতিহ্যবাহী এই খয়ের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা খয়ের শিল্পের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। তা হলো-প্রাচীন উৎপাদন পদ্ধতি, আমদানিকৃত বিদেশি খয়েরের সাথে অসম প্রতিযোগিতা, কাঁচামালের অভাব, ইজারাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী দালালদেও দৌরাত্ম্য, নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি বা বাজারজাতকরণের অসুবিধা, বিক্রিত পণ্যের মূল্য পেতে দীর্ঘসূত্রতা ও হয়রানি এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এক সময়ের বিষিষ্ট খয়ের ব্যবসায়ী নাজমুল হক বলেন, সরকারি উদ্যোগে খয়ের গাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, উৎপাদন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ, শিল্পের সাথে জড়িত মালিক ও শ্রমিকদের কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের উচ্ছেদ করা, অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টি ও বিদেশে রফতানির ব্যবস্থা করা এবং বিদেশি খয়ের আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী খয়ের শিল্পের সুদিন আবারও ফিরে আনা যাবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

এ বিষয়ে চারঘাট বাজার খয়ের ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল রাজ্জাক বলেন, খয়ের গাছ পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। খয়ের গাছের প্রচুর অভাব। তাই এই গাছ বেশি দামে কেনাবেচা হয়। এক সময় চার ঘাটে একশর বেশি কারখানা ছিল। বর্তমানে ৮ থেকে ১০টি কারখানা টিকে আছে। তাও খায়ের গাছের অভাবে ধুঁকছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের এদিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে খয়ের আসে। এ খয়ের থেকে আমাদের খয়রের গুণগত মান ভালো। বেশির ভাগ ঢাকা, রংপুর, ঠাকুরগাঁওতে বিক্রি হয়। বাজার ব্যবস্থা খুবই ভালো। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারও এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করেন।

এ বিষয়ে মাহবুবুর রহমান বন কর্মকর্তা বলেন, খয়ের গাছ বৃদ্ধি করার অংশ হিসেবে রাজশাহীতে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রত্যেক বছর ১০ হাজার  খায়ের গাছ লাগানো হচ্ছে। এবং কৃষকদের খয়ের গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহ করা হচ্ছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে খয়ের গাছের সংকট কেটে যাবে বলে জানান।

আরবি/জেডআর

Shera Lather
Link copied!