ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা একাধিক মামলার আসামী বরিশালের গৌরনদী পৌরসভার টানা তিনবারের মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারিছুর রহমানকে গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর রামপুরা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে মঙ্গলবার শেষ কার্যদিবসে বরিশাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সারাহ্ ফারজানা তার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। হারিছের গ্রেপ্তারের খবরে গৌরনদীজুড়ে দিনভর মিষ্টি বিতরণ এবং জুতা ও ঝাড়ু মিছিল করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। হারিছের ক্ষমতার থাবায় এতদিন ভয়ে চুপ থাকলেও গ্রেপ্তারের পর তার (হারিছ) অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে জনগন।
উপজেলা ঘুরে জানা যায়, বরিশাল-১ আসনের সদ্য সাবেক সাংসদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর আশির্বাদপুষ্ট হারিছ এক ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন টানা তিনবার। শুধু গৌরনদী পৌরসভা নয়; হারিছের রাজনীতির থাবা ছিল পুরো গৌরনদী উপজেলাজুড়ে। এছাড়াও ভিন্নমতাদর্শী নেতাকর্মীদের হত্যাচেষ্টা, টর্চার সেলে নিয়ে নিজহাতে অমানুষিক নির্যাতন, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের জোরপূর্বক নিজ দলে যোগদান করানো ও সাংবাদিক সংগঠনে প্রভাব বিস্তারসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন হারিছ। এমনকি বির্তকিত এই হারিছের হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও।
গৌরনদী উপজেলা ছাত্রদলের আহবায়ক রুবেল গোমস্তা জানান, সাড়ে চার দশক ধরে বরিশাল আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক অভিবাবক বনে যাওয়া আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছত্রছায়ায় গৌরনদীতে একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল হারিছ। সরকারি-বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষক, নৈশ্য প্রহরী নিয়োগ থেকে শুরু করে বাজার কমিটি, মসজিদ-মন্দির কমিটিও ছিল তার নিয়ন্ত্রনে এমনকি টিসিবি পণ্য থেকে শুরু করে নানা অনুদানেও প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। ক্ষমতায় থাকাকালীন আমলে সকল কাজ পেয়েছেন তার পছন্দের ঠিকাদাররা। কাউন্সিলরদের মধ্যেও করেছেন বৈষম্য। আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে পৌরসভার কাঙ্খিত সেবা পায়নি সাধারণ জনগণ বরং পৌরসভায় গেলে দুর্ব্যবহারের কারণে জন্ম নিবন্ধন থেকে যেকোন ধরনের প্রত্যয়নে স্বাক্ষর আনতে যেতে ভয় পেতেন সাধারণ জনগন। তার দুর্নীতি ছিল মাত্রাহীন ও লাগামহীন।
গৌরনদী উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব শরীফ জহির সাজ্জাদ হান্নান জানান, ২০০৬ সালে বড় ভাই হাবিবুর রহমানের বিশেষ সুপারিশে গৌরনদী উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক হিসেবে পদ পায় হারিছ। এরপর ২০১১ সালে প্রথম মেয়র এবং ২০১২ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়ে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একাধারে পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় গৌরনদীতে হারিছ বাহিনী নামে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম শুরু করে হারিছ। ফলশ্রুতিতে টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি, বাড়ি, ডিস লাইন দখল, নদীর বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্যাতনসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও অপকর্মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন হারিছ। এমনকি হারিছুর রহমানের আপন ভাই হাবিবুর রহমান কয়েক মাস আগে গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করে বলেছিলেন হারিছের এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করায় হারিছ তার ভাইদেরকেও বাড়ি ছাড়া করেছেন। এবং গৌরনদীর দানব হারিছ তাদের বাড়িটিকে চর্টার সেল বানিয়ে সেখানে রাতের বেলায় মানুষদের ধরে এনে অত্যাচার নির্যাতন করে বলেও জানান তার আপন ভাই হাবিব। হারিছের এই অবৈধ সম্পদের সুষ্ঠ তদন্ত পূর্বক আইনের আওতায় আনার জন্য দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই নেতা।
গৌরনদী উপজেলা বিএনপি’র আহবায়ক সৈয়দ সরোয়ার আলম বিপ্লব জানান, গৌরনদীর সকল দপ্তর ও কাজের ধরন অনুযায়ী হাসানাত আব্দুল্লাহকে ১০% থেকে ১২% টাকা দিতে হত। আর এ সকল কাজ ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র হারিছুর রহমান। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিন) প্রকল্পের শ্রমিক সাপ্লাই দিতেন হারিছ। গৌরনদীতে প্রতিদিন ৩০০ লেবার * ৪০ দিন * ৪০০ টাকা = ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে সেই টাকা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে পৌছে দিতেন হারিছ। আর এসব কাজে হারিছকে সহায়তা করতেন উপজেলার কতিপয় ইউপি চেয়ারম্যানরা। তাই হারিছসহ একই ব্যক্তিকে প্রতিবার নমিনেশন দিয়ে পুরষ্কিত করতেন হাসানাত আবদুল্লাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও বরিশাল-১ আসনের সদ্য সাবেক সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং তার পুত্র স্ব-ঘোষিত যুবরাজ আশিক আবদুল্লাহ। এছাড়াও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পর আত্মগোপনে রয়েছেন, গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচএম জয়নাল আবেদীন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান শামীম, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আনিচ ফকির, উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জুবায়ের ইসলাম সান্টু, সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি সুমন মাহমুদ, হারিছের ব্যক্তিগত সহকারি কালা আলামিন, হারিছ বাহিনীর প্রধান ক্যাডার শরীফ নাহিয়ান ইসলাম রাতুল, মিঠু বেপারীসহ প্রায় অর্ধশত উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা।
আপনার মতামত লিখুন :