গত বছরের ৪ আগস্ট ফেনীর ইতিহাসে ঘটেছিল বিভীষিকাময় একটি গণহত্যার অধ্যায়। ওইদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহিপালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন যোহরের নামাজ আদায় করছিলেন; ঠিক তখনই আওয়ামী লীগের দুই শতাধিক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা নিজাম হাজারী এমপির নির্দেশে পাখির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। দুপুর ১টা ৪৭ মিনিট থেকে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগের এ কিলিং অপারেশনে ১০ মিনিটের মধ্যেই মহিপাল হয়ে ওঠে মৃত্যুর উপত্যকা। এতে অন্তত তিন শতাধিক ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ এবং ৭ শিক্ষার্থী মারা যায়। ওইদিন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও ফের হামলার শিকার হয় ছাত্র-জনতা।
সূত্র থেকে জানা যায়, আন্দোলনের সময়ে ফেনীর ট্রাংক রোড, ইসলামপুর রোড, তাকিয়া রোড, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক, কলেজ রোড, রেলগেইট, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ ফেনী শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করে কোটা বিরোধী আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। ফেনী শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন ও ট্রাংক রোড অবরোধের মাধ্যমে ৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটে।
এরপর ১৪ জুলাই কোটা বিরোধী শিক্ষার্থীরা ট্রাংক রোডে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন এবং রাষ্ট্রপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে ১৬ জুলাই দুপুরের দিকে ফেনী শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ১০/১৫ জনের একটি দল নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করে। এ বিক্ষোভে হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের সভাপতি ও সদর উপজেলা যুবলীগ নেতা মুন্নার নেতৃত্বে হামলা করে ব্যানার ছিনিয়ে নেয়া হয়।
একই দিন ছাত্র জনতার উপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিকালেই পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা গুদাম কোয়াটার এলাকায় রেল লাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। ১৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা শহরের ট্রাংক রোডে বিক্ষোভ নিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেই ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহাম্মদ তপুর নেতৃত্বে পুলিশের সামনেই তাদের পিটিয়ে ৪০-৫০ জনকে আহত করে। ওই দিন বিকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সমর্থনে শহরের তাকিয়া রোড থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে ফেনী জেলা ছাত্রদল। ওই মিছিলের পেছনের অংশ শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের জগন্নাথ মন্দির পৌঁছালে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এতে দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় অন্তত ৭০ জন আহত হয়।
শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন ও আবু সাঈদ হত্যার প্রতিবাদে ১৯ জুলাই ফেনী শহরের সেন্ট্রাল হাইস্কুলের সামনে থেকে আন্দোলনকারীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে আসার চেষ্টা করলে পুলিশ তাকিয়া রোডের মাথায় তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে সেখানে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বসে গেলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরাতে চাইলে সংঘাত শুরু হয়। এই সংঘর্ষে আন্দোলনকারীদের অন্তত ৩০ জন আহত হয়।
১৭ ও ১৯ তারিখের সংঘর্ষের ঘটনায় ফেনী মডেল থানায় পৃথক ২টি মামলায় বৈষম্যবিরোধী, বিএনপি ও জামায়াতে ৪০০ জনকে আসামি করে গণগ্রেপ্তার শুরু করে পুলিশ। এতে ছাত্র জনতা আরও ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে।
২১ ও ২২ জুলাই ফেনীর বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলেও জেলায় কোথাও কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। ২৬ জুলাই ফেনীর জহিরিয়া মসজিদের সামনে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয় কোটা বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীসহ বিএনপি জামায়াত নেতাকর্মীরা।
২৯ জুলাই দেশজুড়ে কারফিউ ভেঙে ফেনীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ও ছাত্রদলের কর্মীরা। এ মিছিলের কারণে ব্যাপক বেকায়দায় পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
১ আগস্ট সকাল থেকেই বৈষম্যবিরোধীদের কর্মসূচি থাকলেও শহরের ট্রাংক রোড আওয়ামী লীগের দখলে থাকায় সংঘাত এড়াতে ছাত্ররা কর্মসূচি পালন করেনি। ওই দিন সন্ধ্যায় ছাত্র নেতা তাজিম ও যোবায়েরের নেতৃত্বে শহরের ভেতরের বাজার থেকে মোমবাতি জালিয়ে বিক্ষোভ নিয়ে রিমেম্বার আওয়ার হিরোজ কর্মসূচি পালনের জন্য ট্রাংক রোডে আসার চেষ্টা করলে প্রেসক্লাবের গলিতে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। দীর্ঘ আধঘণ্টা চেষ্টার পর অতিবৃষ্টির কারণে শিক্ষার্থীরা পিছু হটে। ৯ দফা দাবিতে ৩ আগস্ট শিক্ষার্থীরা কাপনের কাপড় বেঁধে শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক থেকে বিক্ষোভ নিয়ে খেজুর চত্ত্বরে সমাবেশ করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে তাদের কর্মসূচি ঠেকাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়ায় ফেনী শহরে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। লালপোল, মহিপাল, ট্রাংক রোডের বিভিন্ন গলির মাথা, এসি মার্কেটের সামনে সব সময় শত শত আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো।
৪ আগস্ট সকাল থেকেই ফেনীর ট্রাংক রোডে বৈষম্যবিরোধীদের উঠতে দেয়নি পুলিশ ও আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে ১ দফা দাবিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বৈষম্যবিরোধীদের ব্যানারে ফেনীর মহিপালে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। ওই সময়ে মিছিলে বিক্ষোভে মুখরিত হয় মহিপাল ফ্লাইওবারের নিচে চৌরাস্তার মোড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে অংশগ্রহনকারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিক্ষোভে যোগ দেন শিক্ষক, সাংবাদিক ও অভিভাবকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। সকাল ১১টার দিকে শহরের ট্রাংক রোডে বিএনপি নেতাকর্মীরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে বিএনপির অনেকেই আহত হয়।
দুপুরের দিকে তৎকালীন এমপি ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারীর নির্দেশে অন্তত দুই শতাধিক অস্ত্রধারীকে নিয়ে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী মহিপালের দিকে রাওয়ানা হয়। অস্ত্র উচিয়ে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা মহিপালের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে শহরবাসী আতঙ্কিত ও ভীতসন্তস্ত হয়ে হতবাক হন। দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে যোহরের নামাজ শুরু করেন। তাদের নামাজ শেষ হতে না হতেই ১টা ৪৭ মিনিটের সময় আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা মহিপাল চৌরাস্তায় থাকা ছাত্র জনতার উপর এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষনে প্রাণ ভয়ে ব্যবসায়ী, পথচারীসহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারীরা দিকবিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মাঝেই ফাঁকা ও নিস্তব্দ হয়ে যায় মহিপাল এলাকা। হামলাকারীরা মহিপাল থেকে ট্রাংক রোডের দিকে চলে আসলে শুরু হয় আন্দোলনকারী, পথচারী আহতদের আত্মচিৎকার।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে মহিপালে গুলিবিদ্ধ বাহার উদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারীরা এলোপাতাড়ী গুলি বর্ষণের পর মহিপালের সার্কিট হাউজ রাস্তার মাথায় কয়েক জনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। অমরা সবাই তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্যই বুদ্ধিশূণ্য হয়ে পড়ি। কেউ কাউকে দেখার সুযোগ ছিলো না তখন।’
আবদুল কাউয়ুম সোহাগ জানান, ‘নামাজ শেষ করার আগেই আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের উপর নির্বিচারে গুলি শুরু করে। আমাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও নোয়াখালী সড়কের দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অনেকেই ফ্লাইওভারের উপরে উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে উত্তর দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরে হামলাকারীরা চলে আসার পর স্থানীয়রা এগিয়ে এসে আমাদের অনেককে কাঁধে করে, ভ্যানগাড়িতে তুলে, রিক্সায় ভরে বিভিন্ন ফার্মেসি ও হাসপাতালে পৌঁছে দেয়।’
হাসপাতালের এক সিনিয়র নার্স বলেন, ‘দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ হাসপাতালে চাকুরি করছি। জীবনে এতো রক্ত দেখিনি। পুরো হাসপাতাল সড়ক সেদিন আন্দোলনকারীদের রক্তে লাল হয়ে গেছে। আমরা হতবাক অবস্থায় সাধ্যমত স্যারদের সঙ্গে থেকে চিকিৎসা দিয়েছি।’
আন্দোলনকারী মুয়াজ মুবাস্সির বলেন, ‘সেদিন মহিপাল থেকে আমি ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে এসে দেখি শুধু রক্তাক্ত দেহ আসছে। কোনটি জীবিত; কোনটি মৃত তা বুঝার সাধ্য ছিলো না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর ঠাঁই না হওয়ায় কয়েকজন চিকিৎসক রাস্তায় চিকিৎসা দেয়া শুরু করেন। তবে কয়েকজন চিকিৎসককে আওয়ামী লীগের নির্দেশনায় চিকিৎসা না দিয়ে দর্শনার্থীর ভূমিকায় দেখেছি।’
সংগঠক মোহাইমিন তাজিম বলেন, ‘সেদিন আমাদের আহতদের চিকিৎসা না দিতে আওয়ামীলীগের নেতারা হাসপাতাল মালিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ডায়াবেটিস হাসপাতালে কয়েকজন আহত চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও তাদের উপর ছাত্রলীগ নেতা কালা মোহনের নেতৃত্বে হামলা করা হয়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আমাদের আহতদের চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ায় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ি আমরা।’
তৎকালীন সময়ে ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন মহিপালের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৬ জন ঘটনাস্থলে মারা যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেন। এছাড়াও ৩ শতাধিক গুলিবিদ্ধ হতে পারে বলে ধারণা করেন। পরে চিকিৎসাধিন অবস্থায় আরও ১ জনের মৃত্যু হয়।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. রুবাইয়াত বিন করীম জানান, ‘ফেনীর মহিপাল ও ট্রাংক রোডে হামলার ঘটনায় আমরা ৭ জনের মৃত্যু ও ৪ শতাধিক আহতের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। যাছাই বাছাই শেষে আহতদের মধ্য থেকে ৪০৬ জনের গ্যাজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। তাদের সংস্থাপন ও চিকিৎসার বিষয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
ফেনী মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ সামছুজ্জামান বলেন, ‘ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে হামলার ঘটনায় ৭টি হত্যা ও ১৫টি আহতের মামলা রেকর্ড হয়েছে। হত্যা মামলায় ৭৮২ জন এজহারভুক্ত আসামীর মাঝে ৫৫ জন ও তদন্তে নাম পাওয়া ৩৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও আহত মামলা গুলোর মাঝে ১ হাজার ৫ শত ৭৭ জন এজহার নামীয় আসামীর মাঝে ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর বাহিরে তদন্তে নাম পাওয়া ২৬৪ জনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
তিনি জানান, এনই মধ্যে হত্যা ও আহতের ২২ মামলায় ২ হাজার ৩ শত ৫৯ জন এজহারভূক্ত আসামীর মাঝে ১৪৬ জন এবং তদন্তে নাম পাওয়া ৫৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকীদের গ্রেপ্তারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এজহারভূক্ত অনেক আসামী দেশান্তরিত হওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না।
আপনার মতামত লিখুন :