ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গাজীপুরে অলিগলিতে শত শত ভুয়া দন্ত চিকিৎসক, বিপাকে রোগীরা

গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০৯:৪০ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

গাজীপুরে ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করেই দেওয়া হচ্ছে দন্ত চিকিৎসা। কিন্তু কোথাও নেই বৈধ ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। তারা ডিগ্রি ছাড়া নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা চালাচ্ছেন ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো এসব চিকিৎসালয়ে। অনেক রোগীই জানেন না, যিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি মূলত অনুমোদিত চিকিৎসক নাকি হাতুড়ে।

গাজীপুর জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে ভুয়া দন্ত চিকিৎসালয়। অনুমোদিত দন্ত চিকিৎসক না হয়েও এসব ভুয়া চিকিৎসক দাঁতের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব থাকায় দিন দিন ভুয়া ডেন্টাল ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়ছে। এসব ভুয়া দন্ত চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রোগীরা।

দাঁতের চিকিৎসা নিতে এসে পরে দাঁত সংক্রান্ত নানা জটিল সমস্যায় পড়ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেক রোগী।

গাজীপুর মহানগরীর চৌরাস্তা এলাকার টাঙ্গাইল রোডের এস টাওয়ারের তৃতীয় তলায় ঝুলানো রয়েছে ‘ইভা ডেন্টাল কেয়ার’-এর সাইনবোর্ড। এদের ভিজিটিং কার্ডে এমবিবিএস ডা. নাজমুল কবিরের নাম উল্লেখ আছে। জানা যায়, ডা. নাজমুল কবির সপ্তাহে একবারই এখানে রোগী দেখেন। বাকি দিনগুলোতে নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা করেন এনামুল হক এনাম নামে একজন ব্যক্তি, যার কোনো দন্ত চিকিৎসার ডিগ্রি নেই।

বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) ডিগ্রিধারী ছাড়া কেউ দন্ত চিকিৎসক পরিচয় দিতে পারেন না, এমনকি হাইকোর্টও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে ইভা ডেন্টাল কেয়ারের সাইনবোর্ড ও ভিজিটিং কার্ডে এনামুল হক এনামের নামের আগে ‘ডেন্টিস্ট’ লেখা রয়েছে। এ ব্যাপারে এনামুল হক এনাম কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

চৌরাস্তা মোড় থেকে ঢাকা রোডে ‘এনজেলিক’ ডেন্টাল কেয়ারেও ডা. নাজমুল কবিরের নাম ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা ও প্রেসক্রিপশন দেন জি. সারোয়ার নামে একজন ব্যক্তি। তিনি স্বীকার করেছেন, তার ডিগ্রি নেই, তবুও ভিজিটিং কার্ডে নিজের নামের আগে ‘ডেন্টিস্ট’ লিখে রেখেছেন।

তদন্তে জানা গেছে, ইভা, এনজেলিক ছাড়াও ডা. নাজমুল কবিরের নাম বিভিন্ন সাইনবোর্ড ও ভিজিটিং কার্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। চৌরাস্তা এলাকা ঘিরেই ২৮-৩০টি ভুয়া ডেন্টাল কেয়ারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর বাইরে ময়মনসিংহ রোড, ভোগড়া বাইপাস, কালিয়াকৈর, সফিপুর, মৌচাক, কোনাবাড়ী, জরুন, জয়দেবপুর, মাওনা চৌরাস্তা, বোর্ডবাজার, টঙ্গীসহ গাজীপুর জেলায় কয়েক হাজার ভুয়া দন্ত চিকিৎসালয় গজিয়েছে।

রোগী ও ভুক্তভোগীরা জানান, এসব চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন তারা। অনেক সময় তারা জানেন না, যিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি অনুমোদিত চিকিৎসক নাকি হাতুড়ে। আইন ফাঁকি দিতে বিভিন্ন কৌশলও ব্যবহৃত হচ্ছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, বৈধ সনদ ও নিবন্ধনবিহীন কেউ ডাক্তার বা দন্ত চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC) অনুযায়ী, এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ ‘ডাক্তার’ বা ‘ডেন্টিস্ট’ পদবি ব্যবহার করতে পারবে না।

শাহ আলম নামের একজন রোগী বলেন, ‘ভিজিটিং কার্ডে এমবিবিএস ডা. নাজমুল কবিরের নাম দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম, পরে জানতে পারি, যিনি আছেন তিনি আসলে নাজমুল কবির নন। তাই চিকিৎসা করাই হয়নি।’

নাজমুল কবির জানান, তিনি একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বা জটিল রোগীর জন্যই ওই চেম্বারে আসেন।

অনেকে ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের নাম ব্যবহার না করে নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ রোডের সরকার মার্কেটে ‘রাব্বি ডেন্টাল কেয়ার’-এ ডা. কে. এম. আশরাফুল আলম দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তবে তিনি বিএমডিসি-র নিবন্ধিত ডাক্তার নন। ভোগড়া বাইপাসের মসজিদ মার্কেটের ২য় তলার ‘সাহিদা ডেন্টাল কেয়ার’-এ চিকিৎসা করছেন শাহিদা খানম ও মো. রাশেদুল ইসলাম। টাঙ্গাইল রোডের ইটাহাটা এলাকার ‘শিশির ডেন্টাল কেয়ার’-এ চিকিৎসা দেন মো. সাইদুর ইসলাম। তারা সবাই সার্টিফাইড ডাক্তার নন, তবু দীর্ঘদিন দন্ত চিকিৎসা করছেন।

এ ছাড়াও চৌরাস্তার মসজিদ মার্কেট ও আশেপাশের মার্কেটে ডজনখানেক ডেন্টাল কেয়ার রয়েছে। এরা ‘ডিডিটি’, ‘বিটিআই’, ‘ডিএমটি’, ‘ডিএইচএমএস’, ‘বিএইচবি (ঢাকা)’ ইত্যাদি পদবি ব্যবহার করছেন। তবে এসব পদবির কোনো স্বীকৃতি নেই।

রাব্বি ডেন্টাল কেয়ারের কেএম আশরাফুল আলম জানান, ‘দন্ত চিকিৎসায় অভিজ্ঞতা থাকলেও আমি ডিপ্লোমাধারী; বিএমডিসি বা বিডিএস ডিগ্রী নেই।’

গাজীপুর সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান বলেন, ‘ডিগ্রীধারী (এমবিবিএস-বিডিএস) ব্যতীত অন্য কেউ নামের আগে ডাক্তার বা দন্ত চিকিৎসক পদবি ব্যবহার করতে পারবে না।’

বর্তমানে ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করে ভুয়া দন্ত চিকিৎসালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।