ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫

নানা সমস্যায় জর্জরিত শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৫, ১১:৩১ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

অনিয়ম-দুর্নীতি, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য এবং চিকিৎসকদের নিয়মিত চেম্বারে অনুপস্থিতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে যশোরের শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও সেবার মান বাড়েনি। ৩১ শয্যার জনবল দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে ৫০ শয্যা হাসপাতালের কার্যক্রম, ফলে চিকিৎসা সেবায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, ভোগান্তিতে পড়ছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। নিম্নমানের সেবা ও বিশৃঙ্খল পরিবেশের কারণে দিন দিন কমছে হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা।

জানা গেছে, ১৯৬০ সালে উপজেলার দক্ষিণ বুরুজবাগান (নাভারণ) এলাকায় নির্মিত হয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা, বেনাপোল স্থলবন্দর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় চার লক্ষ মানুষের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা এটি। ২০১৫ সালের ৩ মার্চ হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও জনবল, অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি হয়নি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, মেডিকেল অফিসারের পদ ১৬ জন থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। কনসালট্যান্টের পদ ১০ জনের বিপরীতে আছেন ৪ জন। নার্সের সংখ্যা ৩৪ জন থাকার কথা থাকলেও আছেন ২৮ জন।

স্যাকমো পদে ১৪ জনের বিপরীতে রয়েছেন ৭ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৯৪ জনের পরিবর্তে ৪৩ জন এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ২২ জনের জায়গায় আছে ৯ জন। ফলে মোট ১৯৯ জনের পরিবর্তে প্রায় অর্ধেক জনবল দিয়ে চলছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। জনবল ঘাটতির সংখ্যা ৯৯ জন।

এছাড়া রয়েছে সার্জারি যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা, হাসপাতালে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ওয়ার্ডে পানি–বিদ্যুৎ সংকট, দুর্গন্ধযুক্ত বাথরুমসহ বহু সমস্যা। প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি অপারেশন থিয়েটার দীর্ঘদিন ধরে অচল পড়ে রয়েছে।

হাসপাতালে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন, ভর্তি হন ৩৫-৪০ জন। কিন্তু চিকিৎসা দিতে না পারায় অধিকাংশ রোগীকে জেলা হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি অনেকের অভিযোগ, ডাক্তাররা অফিস সময়ে প্রাইভেট চেম্বারকে অগ্রাধিকার দেন।

চিকিৎসা নিতে আসা ফারিবা আক্তার বলেন, ‘সকাল আটটা থেকে লাইনে আছি, সাড়ে ১১টা হলেও এখনো ডাক্তারের দেখা পাইনি। কীভাবে চিকিৎসা নেব।’

আরেক স্বজন অভিযোগ করেন,‘এখানে নেই সঠিক চিকিৎসক, নেই মানসম্মত খাবার, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ। সবকিছু সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।’

রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, ডাক্তার ও ল্যাব টেকনিশিয়ানরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠান। হাসপাতালের বাথরুম নোংরা, পুরুষ-মহিলা রোগীদের একই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। রাতে ফ্যান-লাইট না থাকায় ওয়ার্ডগুলোতে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। হাসপাতালের চারটি কেবিন সবসময় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দখলে থাকে।

সরকারি খরচে রোগীদের প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহ করা হলেও তা নিম্নমানের। তালিকাভুক্ত খাবার দেওয়া হয় না। বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সামান্য দেওয়া হয় গজ, ব্যান্ডেজ, তুলার মতো সাধারণ জিনিসও কিনতে হয় বাইরে থেকে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দালাল চক্র ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট হাসপাতালটিকে জিম্মি করে রেখেছে। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়। টেন্ডারে উল্লেখিত মানের সরঞ্জামের পরিবর্তে নিম্নমানের জিনিস সরবরাহ করা হয়। স্টোরে কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও নাইট গার্ড নেই, ফলে সব সময় চুরির ঝুঁকি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, অবিলম্বে সংস্কারকাজ, পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করলে এই হাসপাতালে মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।

রোগীদের নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক পারভেজ বলেন, একই ঠিকাদার দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য সরবরাহ করছে। ভালো খাবার দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।

তবে হাসপাতালে টেস্ট না করে বাহিরে পাঠানোর অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, জনবল সংকটের কারণে ৩১ শয্যার জনবল দিয়ে ৫০ শয্যার সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। কারও বিরুদ্ধে রোগী পাঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।