বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে বা সঙ্গে মিলিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন বিষয়ক গণভোট আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ তীব্র আকার ধারণ করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশপত্র হস্তান্তর করেছে। সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কারের ওপর জনগণের সরাসরি মতামত জানাতে গণভোট আয়োজন করা হোক।
নির্বাচনী কমিশনকে যথাযথ আইন প্রণয়ন করে গণভোটের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। ভোটারদের ব্যালট পেপারে প্রশ্ন থাকবে: ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’ ভোটাররা তাদের মতামত ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে প্রকাশ করবেন।
‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোট কী
গণভোট বা রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের মতামত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘হ্যাঁ ভোট’ ও ‘না ভোট’ নামে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জনগণকে কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, নীতি বা সংবিধান সংশোধনী সম্পর্কে তাদের সম্মতি বা অসহমতি প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হয়।
‘হ্যাঁ ভোট’ সাধারণত সমর্থন বা অনুমোদন নির্দেশ করে। অর্থাৎ, ভোটার যদি প্রদত্ত প্রস্তাবের পক্ষে থাকেন বা সেটি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন, তারা ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন।
অন্যদিকে, ‘না ভোট’ নির্দেশ করে অসহমতি বা বিরোধিতা। ভোটার যদি প্রস্তাবিত নীতি বা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে থাকেন, তারা ‘না’ ভোট দেন। এটি মূলত প্রস্তাবটি অনুমোদিত হওয়া উচিত নয়, এমন জনগণের মত প্রকাশ।
বাংলাদেশের প্রথম গণভোটের অভিজ্ঞতা
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে দেশের ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন ভোটার অংশ নেন। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলা ভোটে মোট ভোটারের ৮৮.০৫ শতাংশ ভোট দেন। বৈধ ভোটের মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোটের হার ছিল ৯৮.৮৮ শতাংশ, এবং অনাস্থা সূচক ‘না’ ভোটের হার ছিল মাত্র ১.১২ শতাংশ।
সেই সময় ভোটের আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশন ৬২টি মহকুমার রিটার্নিং অফিসার, ৭৫৯ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ২১ হাজার ৭৭০ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৫৮ হাজার ৩০২ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও ৫৮ হাজার ৩০২ জন পোলিং অফিসার নিয়োগ করেছিলেন।
এছাড়াও ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৭৭০টি এবং ভোটকক্ষের সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ৩০২টি। প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে ৩০ মে সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ৩০ ঘণ্টার মধ্যে পুরো দেশের ফলাফল সংগ্রহ ও প্রচার করা সম্ভব হয়েছিল। এই গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সরাসরি রাষ্ট্রপতির নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি আস্থা বা অনাস্থা প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিল।
এবার কী হবে
২০২৫ সালের খসড়া জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কারের বিভিন্ন প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজনের সুপারিশ এসেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা লিখিতভাবে সরকারের কাছে সুপারিশ দিয়েছি। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত একটি গণভোটের তফসিল নির্ধারণ করা উচিত।’
গণভোটের প্রস্তুতি হিসেবে আইন প্রণয়ন ও ভোটারদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভোটাররা ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করবেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হ্যাঁ’–‘না’ ভোটের ঢেউ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে ‘গণভোট’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। ব্যবহারকারীরা ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ লেখা পোস্টার, ব্যানার এবং স্ট্যাটাস শেয়ার করে ভার্চুয়াল প্রচারণায় নেমেছেন। ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন ‘না!’ ভোটের পক্ষে পোস্ট শেয়ার করেছেন। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনুভা জাবীন লিখেছেন, ‘গণমানুষ নীরবে বিপ্লব ঘটায় দিবে।’
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পারস্পরিক ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসাথে আয়োজন হোক, আর জামায়াত চাইছে নভেম্বর মাসে আলাদাভাবে গণভোট হোক। এই বিতর্কের মধ্যে এনসিপি মধ্যস্থতা করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে।
প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও আইনগত ব্যবস্থা
গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ আইন প্রণয়ন করে দায়িত্ব নিতে হবে। ভোটার তালিকা, ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্স এবং পোলিং কর্মকর্তাদের নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিটি ভোটকেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হবে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘গণভোট কবে হবে তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা সহায়তা করার জন্য থাকব।’
রাজনৈতিক গুরুত্ব
গণভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সংবিধানিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মত প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সংসদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রচলিত পদ্ধতির থেকে ভিন্ন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গণভোটের ফলাফল দেশের রাজনৈতিক, আইন এবং সংবিধানিক কাঠামোর দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বর্তমান সময়ে ‘হ্যাঁ’–‘না’ ভোটের আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে এবং সাধারণ মানুষও অনলাইনে সক্রিয়ভাবে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে।
গণ ভোট নিয়ে বিএনপির অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে এখন সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি রয়েছে বিএনপির দিকে। দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভোটের পরিবেশ তৈরি করাই এখন প্রধান অগ্রাধিকার।
বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, গণভোটের মাধ্যমে সরকার কাঠামো বা সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি এখন এজেন্ডায় নেই। বরং সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট আয়োজন- এই দুই দাবিই দলটির মূল লক্ষ্য। দলের এক নীতিনির্ধারক বলেন, ‘দেশে ভোটারদের আস্থা ফেরানো ছাড়া কোনো গণভোটই জনগণের ম্যান্ডেট হিসেবে গণ্য হবে না।’
তবে দলের ভেতরে একটি অংশ মনে করছে, গণভোটকে পুরোপুরি বাতিল না করে কৌশলগত অবস্থান নেওয়া উচিত। কারণ আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকৌশলের দিকে, এবং গণভোট বিষয়টি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গণভোট নয়, আমরা চাই জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের নিশ্চয়তা।’
দলের স্থায়ী কমিটিতে গণভোট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নেতারা আপাতত ‘অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ’ কৌশলই গ্রহণ করেছেন। বিএনপি মনে করছে, গণভোট যেন কোনো দল বা গোষ্ঠীর বৈধতা প্রমাণের হাতিয়ার না হয়; জনগণের অংশগ্রহণ ও আস্থাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে, যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তবে সেটি নির্বাচন একই দিনে আয়োজন করা হোক। এতে সময়, ব্যয় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সুবিধা নিশ্চিত হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গণভোটে সরাসরি সমর্থন বা বিরোধিতায় বিএনপির যে কোনো সিদ্ধান্তেরই রাজনৈতিক প্রভাব পড়বে।
গণ ভোট নিয়ে জামায়াতের অবস্থান
জামায়াতে ইসলামী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সুপারিশে গণভোটের সময়সূচি উল্লেখ করা হয়নি, যা দলের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। জামায়াতের দাবি, নভেম্বরের মধ্যে গণভোট করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, সুপারিশে বলা হয়নি আদেশ কে জারি করবে। জামায়াতের অবস্থান হলো, আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়, তাই আদেশ জারি করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে।
জামায়াত প্রথম খসড়া পদ্ধতির পক্ষপাতী, যা অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করতে হবে। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নভেম্বরের গণভোটের পর ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা করে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন সম্ভব, যা দল যৌক্তিক মনে করছে।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, আদেশ জারি হওয়ার পর সরকার সময় নির্ধারণ করবে। তবে জামায়াত মনে করে, গণভোটকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে এবং তা সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।
গণ ভোট নিয়ে এনসিপির অবস্থান
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণভোটকে কার্যকর ও ইতিবাচক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে। দলের নেতারা মনে করেন, নির্বাচনের আগে যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তা হলে তা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবমুক্ত থাকবে এবং জনগণের মতামতকে সরাসরি গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানিয়েছেন, জুলাই জাতীয় সনদ অনুযায়ী ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে গণভোটের বিধান রাখা হয়েছে, যা দলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলেন, যদিও আদেশ জারি কে করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে গণভোট প্রক্রিয়ার প্রস্তাবকে আমরা সঙ্গতিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য মনে করি।
অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, সুপারিশে উল্লেখিত যে পদক্ষেপগুলো রয়েছে- যেমন, ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার না হলে সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধনের বিষয়টি- সেগুলোও গণভোট প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করছে। এছাড়া এনসিপি উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কিছু ভাষাগত অস্পষ্টতা থাকলেও তা পর্যালোচনা করে গণভোটের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হবে।
এনসিপির পক্ষ থেকে এটি স্পষ্ট করা হয়েছে যে, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে, যা দলের রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে সাধারণ মানুষের মতামতকে প্রাধান্য দেবে। ফলে, এনসিপি গণভোটকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখছে এবং সেই ভিত্তিতেই আগামী দু-এক দিনের মধ্যে জুলাই সনদে স্বাক্ষর বিষয়ক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

