গত এক বছরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মানচিত্রে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে নয়, বরং চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও গতিশীল এবং বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। সরকারি ও রাজনৈতিক দলগুলো, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজ- সব স্তরে চীনের সঙ্গে সংযোগ বেড়েছে, আর সেই সংযোগ কেবল অর্থনীতিতে নয়, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নবায়িত সম্পর্ক ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এবং উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায়, ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর বিএনপির চার সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। এই সফরের মাধ্যমে নতুনভাবে চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়। এরই মধ্যে ২৭ নভেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বেইজিং সফর করে। এই সফরের মূল আকর্ষণ ছিল চীনের সিনচিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ পরিদর্শন।
এরপর চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের নিয়ে ২২ সদস্যের ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী’ প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায়। দলটি বিএনপি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিস এবং জাতীয় দলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, ছাত্রনেতা ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। ১৩ দিনব্যাপী সফরে তারা বেইজিং, শানশি ও ইউনান প্রদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আধুনিক প্রযুক্তি কোম্পানি এবং অবকাঠামো প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
এদিকে গত ২২ জুন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির ৮ নেতা চীনের বিভিন্ন স্থানে সফর করেন। এছাড়াও সাংবাদিকদের দুটি প্রতিনিধিদলও চীনের আমন্ত্রণে সফর করে। এসব সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ ও বহুমাত্রিক হয়।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালুর পরিকল্পনা, মোংলা বন্দরের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ, রোবোটিক ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন এবং মোবাইল কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও চীনের ওয়ালভ্যাক্স বায়োটেকনোলজি কোং লিমিটেড পরিদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে চীনের অবদান ও সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা খোলা হয়েছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির যুদ্ধজাহাজ চি জিগুয়াং এবং জিং গ্যাংশান চট্টগ্রাম বন্দরে শুভেচ্ছা সফর করে। এছাড়াও চীনা দূতাবাস ঢাকায় বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে ড্রোন শো আয়োজন করে এবং ড্রোন পরিচালনায় বাংলাদেশি প্রশিক্ষণার্থীদের সুযোগ দেয়।
কূটনৈতিক সফর ও ঋণ সুবিধা
এ বছরের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনের ঋণের সুদের হার কমানো এবং পরিশোধ সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়, যা চীন ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে। এরপর মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীনের বেইজিং সফরে যান, যেখানে এক অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি এবং আটটি পৃথক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এই সফরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি চীনা প্রেসিডেন্ট পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ‘এক চীন নীতি’ ও তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে।
কী বলছে চীন
গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, বাংলাদেশ–চীন সম্পর্ক জনগণের স্বার্থে এবং এই সম্পর্ককে তৃতীয় কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো চীনের সঙ্গে সহযোগিতা চায়, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে। তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন ও আত্মনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের জন্য প্রশংসা করেছেন।
রোহিঙ্গা সংকট ও তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে তিনি উল্লেখ করে বলেন, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখতে চায়। তিস্তা প্রকল্পের খরচ প্রায় ১০০ কোটি ডলার এবং এটি সম্পূর্ণ করতে ৭–৮ বছর লাগবে। চট্টগ্রামে চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ইতিমধ্যেই ৩০টি প্রতিষ্ঠান ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।
এছাড়াও চীনের দূতাবাস ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইন আবেদন এবং চিকিৎসা ভিসার জন্য গ্রিন চ্যানেল চালু করেছে। ফলে পর্যটক, ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসা নিতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের জন্য চীনে যাতায়াত সহজ হয়েছে। বিশেষ করে ক্যান্টন ফেয়ারসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক মেলায় বাংলাদেশিরা অংশগ্রহণ করছেন।

