ঢাকা রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

তাড়াইলে বিলুপ্তির পথে দেশীয় প্রজাতির মাছ

তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৫, ০১:৩০ পিএম
তাড়াইলের জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল ও নদী-নালায় এক সময় প্রচুর দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। বর্ষার সময় টেংরা, শিং, মাগুর, কই, বোয়াল, গজার, শোল, পুঁটি, টাকি, খলিশা ও গুড়ি চিংড়ি সহ নানা প্রজাতির দেশি মাছ ছিল স্থানীয়দের প্রধান আহার। এসব মাছ স্থানীয় জনগণের চাহিদা মিটিয়ে পাইকারদের মাধ্যমে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হতো। কিন্তু এখন এসব মাছ যেন অতীতের গল্প হয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় জেলেরা জানান, এখন আর আগের মতো দেশি মাছ ধরা যায় না। অধিকাংশ জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, খাল ও নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব। এতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া, অবৈধ কারেন্ট জাল, রিং জাল, চায়না জাল ও ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহারের কারণে ছোট মাছ ও ডিমও নষ্ট হয়ে হচ্ছে। ফলে দেশি মাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।

উপজেলা সদরের বালিগাতী বাজারের মাছ ব্যবসায়ী সুলতান জানান, আগের দিনে বাজারে দেশি মাছের প্রাচুর্য ছিল। এখন তেলাপিয়া, রুই, কাতলা, পাঙ্গাসের মতো চাষের মাছেই ভরপুর বাজার। ফলে দেশি মাছের দাম বেড়ে গেছে, আর সাধারণ মানুষও সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সহিলাটি বর্মনপাড়ার মাছ ব্যবসায়ী নিতাই বর্মন জানান, আগে আমরা জাল নিয়ে খাল-বিলে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে নিজেদের সংসার চালাতাম। এখন আর সেই সুযোগ নাই। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন প্রতিটি খাল-বিলে সরকারিভাবে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়। সমাজের উচ্চবিত্তরা এসব খাল-বিল ইজারা নিয়ে চড়া দামে হাতবদল করে। এর ফলে আমরা যারা জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ বাপ-দাদার আমল থেকে এ পেশায় আছি এখন তাদের অন্যের ফিশারিতে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।

সরেজমিনে উপজেলার কয়েকটি মাছের আড়ৎ ঘুরেও দেখা গেছে একই চিত্র। কায়করহাটি মাছের আড়তদার স্বপন বর্মনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, দেশি মাছ এখন সোনার হরিণ। বিলে মাছচাষিদের আড়তদাররা অনেক টাকা দাদন দিয়ে থাকে। চাষিরা মাছ আড়তে দিলে সেখান থেকেই কমিশন নিয়ে আড়তদারের পেট চলে। বর্তমানে দেশি মাছ নাই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কিছু দেশি মাছ আড়তে এলে স্থানীয় জনগণ খাওয়ার জন্য কিনতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা বেশি দামে ক্রয় করে নিয়ে যান শহরে বিক্রির উদ্দেশ্যে।

রবিবার (১৯ অক্টোবর) উপজেলার রাউতি ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী পুরুড়া বাজার ঘুরে দেখা যায় ১৫/২০ জন মাছ ব্যাবসায়ী তাদের চাতালে মাছ বিক্রি করছেন। তবে দেশি মাছের চিহ্ন দেখা পাওয়া যায় নাই। পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, চাষের শিং, বিদেশি কৈ, চাষের রুই, মৃগেল এগুলিই দেখা মিলে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন জানান, আমি অত্র উপজপলায় ২ মাস হলো জয়েন করেছি। দেশি মাছ সংরক্ষণে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে। এরই মধ্যে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় থানা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা প্রায় ৪ হাজার মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল উদ্ধার করে ধ্বংস করেছি। তাছাড়া অবৈধ জাল ব্যবহার বন্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে এবং প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগণের সাথে আমরা অবৈধ জাল ও প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরার জন্য প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।

স্থানীয় পরিবেশবিদ ও সচেতন মহল মনে করেন, প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অতি জরুরি। এখনই উদ্যোগ না নিলে তাড়াইলের জলাশয় থেকে দেশি মাছ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে দেশি মাছ শুধু বইয়ের পাতাতেই ছাপায় দেখতে হবে। তবে কিছু কিছু পুকুরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশিয় মাছের চাষ করলেও স্বাদ ও ঘ্রাণের বিস্তর পার্থক্য থেকেই যায়।