দই—বাংলার ঐতিহ্যবাহী এক মিষ্টান্ন, যার স্বাদে মিশে আছে মাটি ও মানুষের গল্প। কিন্তু চারপাশে যখন ভেজালের ছড়াছড়ি, তখন মানুষ হারিয়ে ফেলেছে সেই স্বাদে বিশ্বাস। এমন সময় নওগাঁর বদলগাছীর এক সাধারণ মানুষ সততা আর মানবতার আলোয় ফিরিয়ে এনেছেন সেই হারানো আস্থা। তার নাম মজিবর রহমান, বয়স ৬৫।
তার হাতে তৈরি এক হাঁড়ি দই আজ শুধু খাবার নয়। এটি হয়ে উঠেছে সততা, বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রতীক। তাই স্থানীয়রা স্নেহভরে নাম দিয়েছে “ভালো মানুষের দই”।
বদলগাছী উপজেলার ছোট্ট গ্রাম পাটকোলা। সেখানকার মজিবর রহমান ছিলেন সৎ, সহজ-সরল ও সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তার সরলতার কারণেই সবাই তাকে ডাকতেন “ভালো মানুষ”। আগে তিনি গ্রামে গ্রামে দুধ সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। একদিন ভাবলেন, এত দুধ দিয়ে নিজেই যদি দই বানাই!
প্রথম দিন বানালেন মাত্র দশ হাঁড়ি দই। সেই দশ হাঁড়িই বিক্রি হয়ে যায় মুহূর্তে। এক ক্রেতা খেয়ে বলেন, “আপনার মতো ভালো মানুষ আছে বলেই আমরা এমন স্বাদের দই খেতে পারছি।” সেই কথাতেই জন্ম নেয় নাম—ভালো মানুষের দই।
প্রথমে কেউ কেউ নাম শুনে হাসলেও এখন সেটাই তার ব্যবসার শক্তি। ক্রেতারা বলেন, “নামের মধ্যেই আছে বিশ্বাসের ছাপ।”
কোলা বাজারে দই কিনতে আসা এক ক্রেতা বললেন, “ভালো মানুষের দই অনেক আগে থেকেই চিনি। আমার বাবার আমল থেকেই এই দইয়ের সুনাম শুনে আসছি। স্বাদ অতুলনীয়, ভেজালমুক্ত।”
“চাচা (মজিবর) অনেক বছর ধরে দই বানান। তার দই খেলে মনে হয় গ্রামের আসল স্বাদ এখনো টিকে আছে।”
তবে একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মাথায় প্রচুর আঘাত পান মজিবর রহমান। ভুলে যান সবকিছু। তারপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় দই তৈরির কাজ। কিন্তু হাল ছাড়েননি তার পুত্রবধূ সিমলা বেগম। শ্বশুরের পথ অনুসরণ করে তিনিই এখন এই ব্যবসার হাল ধরেছেন।
সিমলা বলেন, “শ্বশুরের কাছ থেকে দই তৈরির সব কিছু শিখেছি। তিনি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর অনেকেই এসে দই না পেয়ে ফিরে যেতেন। তখন আমি ঠিক করি, এই নাম যেন বন্ধ না হয়।”
এখন প্রতিদিন তৈরি হয় ১০০ থেকে ১৫০ হাঁড়ি দই, আর বিবাহ বা উৎসবে আরও বেশি। বদলগাছী ছাড়িয়ে এই দই পৌঁছে গেছে নওগাঁ, জয়পুরহাট, এমনকি রাজশাহীতেও।
মজিবর রহমান বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই দই তৈরি করি। দইয়ে কোনো ভেজাল দিই না। দুধ দেখেই বুঝতে পারি ভালো না খারাপ। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করি বলেই মানুষ আমার দই ভালোবাসে। এখন একটু সুস্থ। কিন্তু মাঝে ভূলে যাই।”
“ভালো মানুষ যেমন ভালো, তার দই তেমনই ভালো। ২৫-৩০ বছর ধরে তার দইয়ের ব্যবসা চলছে। আজও ভেজালের ছোঁয়া লাগেনি।”
এই দইয়ে কোনো কেমিক্যাল বা ঘন করার উপাদান ব্যবহার করা হয় না। স্থানীয় গাভীর বিশুদ্ধ দুধ দিয়েই তৈরি হয় দই। দামও তুলনামূলক কম। ফলে ক্রেতারা পাচ্ছেন নির্ভেজাল পুষ্টি আর আস্থা, আর উৎপাদক পরিবার পাচ্ছে অর্থনৈতিক স্থিতি।
এভাবেই এক হাঁড়ি দই বদলে দিচ্ছে গ্রামের চিত্র।
দশ হাঁড়ি দই থেকে শুরু হয়েছিলো যাত্রা, আজ তা সততার গল্পে পরিণত। এই গল্প শুধু দইয়ের নয়, এটি এক ভালো মানুষের মিষ্টি সাফল্যের গল্প।