ঢাকা মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

প্রকাশ্যে লুটপাট ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর, ধ্বংসের পথে পর্যটনকেন্দ্র ও পরিবেশ

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৫, ০৮:৪৬ এএম
নৌকা করে নেওয়া হচ্ছে পাথর। ছবি- সংগৃহীত

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এখন আর কেবল সৌন্দর্যের আশ্রয়স্থল নয়; এটি রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য লুটপাটের ঘাঁটিতে। প্রতিদিন হাজারো শ্রমিকের বহরে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পাথর লুট করে নেওয়া হচ্ছে প্রকাশ্যে, প্রশাসনের চোখের সামনেই।

স্থানীয়রা বলছেন, গত এক বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়ে গেছে, অথচ নেই প্রশাসনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ।

সাদা পাথরের ওপারে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি ও লুংলংপুঞ্জির পাহাড়ি ঝরনা থেকে বছরজুড়ে পানি প্রবাহিত হয়। বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে ভেসে আসে পাথরখণ্ড। এসব পাথরের মান ভালো হওয়ায় চাহিদাও ব্যাপক। আগে এগুলো স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সীমিত পরিসরে সংগ্রহ করা হতো, এখন তা রূপ নিয়েছে ‘মুক্ত লুটপাটে’।

পাথর লুট

স্থানীয়রা জানান, গত দুই সপ্তাহে একাধিকবার পাহাড়ি ঢল নামে। ঢলের পর পাথরের স্তর গড়ে উঠলেও এখন দেখা যাচ্ছে কেবল বালু। পরে সেই বালুর নিচ থেকে অবাধে তুলে নেওয়া হচ্ছে পাথর। প্রায় প্রতিদিনই শত শত নৌকা করে নেওয়া হচ্ছে এসব পাথর। শ্রমিকদের ভাষায়, এখন আর রাতের আঁধারে নয়, দিবালোকে প্রশাসনের সামনেই চলে লুট।

স্থানীয়দের অভিযোগ, লুটের নেপথ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। বিশেষ করে, গত বছরের ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই এই লুটপাটের মাত্রা বেড়েছে। বিএনপি ও যুবদলের নেতারা সরাসরি জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে প্রশাসন ‘লোক দেখানো অভিযান’ চালিয়ে দায় সারছে।

চাঁদাবাজির নতুন ধারা

সাদাপাথরে প্রতিদিন কাজ করেন ৪-৫ হাজার শ্রমিক। তাদের অধিকাংশই বহিরাগত। শ্রমিকদের ভাষ্য মতে, আগে পাথর প্রতি ট্রিপে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেত, বিজিবিকে দিতে হতো ৩০০ টাকা। এখন কাউকে দিতে হয় না, তবে কিছু নেশাগ্রস্ত স্থানীয় যুবক ২০০-৩০০ টাকা চাঁদা নেয়। সম্প্রতি ‘সিন্ডিকেট’ চালু হয়েছে- নির্দিষ্ট দামে পাথর বিক্রি করতে হয় নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছেই।

উত্তোলিত পাথর প্রথমে ধলাই নদীর দুইপারে কালাইরাগ, দয়ার বাজার, দশ নম্বর ঘাট, ব্যাটারি ঘাট ইত্যাদি স্থানে বিক্রি হয়। সেখান থেকে পাথর ট্রাকে করে সারা দেশে পাঠানো হয়। ধোপাগোল, গাবতলী, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পৌঁছায় এসব অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর। সব কিছুই চলে প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়েই।

প্রশাসন কোথায়?

সাদা পাথর ঘিরে রয়েছে তিনটি বিজিবি ক্যাম্প, পুলিশের চেকপোস্টও আছে। তা সত্ত্বেও পাহাড়ি ঢলের সময় থেকে গভীর রাত অবধি চলে লুটপাট। কখনো অভিযান চালানো হলেও তা একদিনের বেশি স্থায়ী হয় না। অভিযান শেষে আবার আগের মতো চলতে থাকে কাজ। প্রশাসন বলছে, জনবল সংকটের কারণে তারা নিয়মিত অভিযান চালাতে পারছে না।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে জনবল কম থাকায় পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত জনবল চাওয়া হয়েছে।’

কোম্পানীগঞ্জ ইউএনও আজিজুন্নাহার বলেন, ‘ক্রাশারগুলোতে দ্রুত অভিযান হবে বলে আশা করছি। তবে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।’

চেষ্টা  যেন ব্যর্থ

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট শাখার সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, ‘প্রশাসন ব্যর্থ নয়, কারণ তারা চেষ্টা-ই করেনি। সাদাপাথর রক্ষায় কোনো কার্যকর উদ্যোগ তারা নেয়নি।’

বিএনপি ও যুবদলের নেতারা পাথর লুটপাটে জড়িত বলে স্থানীয়দের অভিযোগ থাকলেও যুবদল নেতারা তা অস্বীকার করেছেন। জেলা যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক বাহার আহমদ রুহেল বলেন, ‘আমাদের কেউ জড়িত নয়। অনেকেই বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

বিএনপি জেলা সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী জানান, ‘তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পর্যটন ও পরিবেশ হুমকিতে

২০১৭ সালে জনপ্রিয়তা পাওয়া সাদা পাথর এলাকা এখন ধ্বংসের মুখে। বিশাল পাথরের স্তূপ, স্বচ্ছ পানির প্রবাহ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই এলাকা পাহাড়ি ঢলে গঠিত হলেও লুটপাটে এর অস্তিত্ব হুমকিতে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, ‘যারা এখন লুটপাট করছে না- এমন কেউ নেই। প্রশাসনের নীরবতা ও ব্যর্থতাই এর জন্য দায়ী। পরিবেশ উপদেষ্টার কার্যালয় পর্যন্ত এটি জানে, তবুও কিছু হচ্ছে না।’

এলাকাবাসীর প্রশ্ন- যেখানে প্রশাসনের ক্যাম্প, পুলিশ চেকপোস্ট, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী সকলে জানেন, সেখানে এই পাথর লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না কেন?

উপদেষ্টার বক্তব্য

এদিকে গতকাল সোমবার (১১ আগস্ট) এক আলোচনা সভায় বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হতাশ কণ্ঠে জানিয়েছেন, ‘সিলেটে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অন্যতম কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ‘সাদাপাথর’ এলাকায়। মনোমুগ্ধকর সেই ‘সাদাপাথর’ এলাকাটি এখন প্রায় বিবর্ণ। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে পর্যটনকেন্দ্রটি। তৈরি হয়েছে নজিরবিহীন লুটপাট কেন্দ্র।’

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পাথর উত্তোলনে সর্বদলীয় ঐক্য দেখছি। একটি সুন্দর জিনিস কী করে হাতে ধরে কেমন অসুন্দর করতে হয় সেটা শিখতে হলে বাংলাদেশে আসতে হবে। চোখের সামনে অপূর্ব সুন্দর একটি জায়গা জাফলং চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখলাম। ধ্বংসলীলা দেখলাম।’

তিনি বলেন, শুনলাম, ‘এই পাথরগুলো নাকি তুলতেই হবে। কেন তুলতে হবে, কেন? কারো কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ পরিসংখ্যান বলছে দেশের চাহিদার মাত্র ৬ ভাগ পূরণ হয় এই পাথরগুলো তুলে। বাকি ৯৪ ভাগই আমদানি করতে হয়। ৯৪ ভাগ আমদানি করতে পারলে বাকি ৬ ভাগ কেন পারলাম না!’

তিনি আরও বলেন, ‘কেন আমরা ভিয়েতনামে গিয়ে ওদের নদীর ইকো ট্যুরিজম দেখি, কেন আমরা জাফলং-এ একটা ইকো ট্যুরিজম করতে পারলাম না! আমরা যেমন সৌন্দর্যমণ্ডিত জাফলং দেখেছি, কেন নতুন প্রজন্ম সেই জাফলং দেখতে পারল না! সেখানে আবার রাজনৈতিক ঐক্য দেখলাম।’