দেশজুড়ে বইছে তীব্র দাবদাহ। দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ পেরিয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৪০.০১ ডিগ্রি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আরও অন্তত তিন দিন আবহাওয়ার এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে।
এদিকে তীব্র গরমের কারণে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ডায়রিয়া, হাঁপানি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরাই বেশি ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। এমনকি কোথাও কোথাও হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এমন অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করার পাশাপাশি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দাবদাহে শিশু, বয়স্ক ও কোমরবিডিটি (বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি) রোগীরা বেশি বিপাকে পড়ছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে মানুষ হাসপাতালে আসছে। তাদের অনেকে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ব্যথা, হিটস্ট্রোক, বমি, ডায়রিয়া, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের কথা বলছেন। এ ছাড়া গলা ব্যথা, কাশি, সর্দি ও ঘুমের সমস্যা বেড়ে যওয়ার কথাও বলেছেন অনেকে। আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা দিচ্ছি। মানুষকেও সতর্ক থাকতে হবে। অনেকে রাস্তার পাশে শরবত পান করেন। যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ ছাড়া তীব্র গরমে রান্না করা খাবারও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই একবেলার রান্না করা খাবার অপর বেলায় খাওয়ার সময় অবশ্যই ভালোমতো পরীক্ষা করতে হবে। তাহলে ডায়রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল শনিবার ঢাকায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৩৮-৩৯.৯ ডিগ্রি হলে সেটাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ধরা হয়। ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়। এর আগে গত শুক্রবার মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস চুয়াডাঙ্গায়। এদিন ঢাকায়ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯.২। যা আজ রোববারও অব্যাহত থাকবে। কয়েকটি জেলায় বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও তা খুবই স্বল্প আকারে হবে।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোববার রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় দেশের দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। সারা দেশে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়ার এমন তপ্ত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে শিশুরা। এর পরেই বয়স্কদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। রোগী বাড়ছে রাজধানীর শিশু হাসপাতালেও। হাসপাতালটিতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিশুদের ভর্তি করাতে নিয়ে আসছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর বাড্ডা থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুসন্তান ইয়াশকে ভর্তি করাতে নিয়ে আসা রোগীর বাবা সুমন চৌধুরী বলেন, গরমে হাঁসফাঁস অবস্থায় বার বার ফ্রিজের পানি পান করেছে ৪ বছরের বাচ্চা ছেলেটি। তার চাহিদার মুখে অনেকবার আইসক্রিমও এনে দিতে হয়েছে। ফলে জন্মের সময় হওয়া নিউমোনিয়া আবারও বেড়েছে। গতকাল রাতে তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়ায় আজ আর দেরি করিনি। সকাল সকালই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ডাক্তাররা ভর্তি করাতে বলেছেন।
এ সময়ে শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুুবুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যে গরম পড়েছে তাতে প্রাপ্তবয়স্করাই কাহিল হয়ে পড়ছেন। এমন অবস্থায় শিশুদের তো কষ্ট বেশিই হবে। তারা এ সময় ঠান্ডাজাতীয় পানীয় পান করতে জিদ করবে। গরম থেকে বাঁচতে তা আপাতদৃষ্টিতে প্রতিকার মনে হলেও যাদের অ্যাজমা বা নিউমোনিয়ার সমস্যা রয়েছে তা আবারও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেক শিশু ঘুমে থাকাকালীন গরমে প্রচুর ঘামে। ওই সময় তাদের ঘাম মুছিয়ে না দিলে তাদেরও ঠাণ্ডা লাগার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই এ ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদের।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে যে বাতাস প্রবেশ করছে, তা কিছুটা জলীয় বাষ্প বয়ে আনছে। এতে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকায়ও বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না বের হতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ সময় বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই সময়ে যারা দীর্ঘক্ষণ বাইরে কাজ কওে, তাদের হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই রোদে কাজ থাকলে প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে। কৃষক ও রিকশাচালকদের মতো যারা রোদে পুড়ে ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করেন, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, বয়স্ক ও শিশুরাও ঝুঁকিতে রয়েছে। গরমে ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরে পানিশূন্যতা বা স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। অনেকের রক্তচাপ ও প্রস্রাব কমে যেতে পারে। গরমে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রির ওপরে উঠলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও পালস (নাড়ির স্পন্দন) কমে যেতে পারে। এ সময় ঘরের বাইরে যতটা কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। যারা প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছেন, তারা পানির সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে স্যালাইনের মতো করে খেতে পারেন। এতে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে বের হওয়া লবণের ঘাটতি পূরণ হবে। এ ছাড়া ঢিলাঢালা সুতি কাপড় পরতে হবে।
তিনি আরও বলেন, তীব্র গরমে অ্যাজমা রোগীদের ২৪ ঘণ্টায় অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করতে হবে। অতিরিক্ত ঘামে ইলেকট্রোলাইট বা শরীরে লবণের ভারসাম্য কমে যেতে পারে। এতে স্থূলতা, কিডনি বিকল রোগী ও বয়স্কদের বেশি ঝুঁকি হতে পারে। ডায়াবেটিস, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, কেমোথেরাপি চলা ক্যানসারের রোগী ও স্টেরয়েড ওষুধ সেবনকারীদেরও তাপপ্রবাহ এড়িয়ে চলতে হবে। হাঁপানি, অ্যালার্জি, রাইনাইটিস, গলা ব্যথা, গলার প্রদাহ থাকলে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান থেকে বিরত থাকতে হবে। ছায়া-শীতল পরিবেশে থাকতে হবে। তাহলেই এ সময়ে সুস্থ থাকা সম্ভব।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রশাসকের পরামর্শ: রোদ এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। একান্ত জরুরি কাজে বাইরে যেতে হলে ছাতা ব্যবহার করুন। প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করুন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করুন। সম্ভব হলে মাঝে মাঝে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিন। হালকা রঙের সুতির ঢিলাঢালা পোশাক পরিধান করুন। অতিরিক্ত রোদের মাঝে বেশি সময় ধরে শারীরিক পরিশ্রমী কাজ ও খেলাধুলা থেকে বিরত থাকুন। সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। পোষা প্রাণী, রাস্তায় থাকা প্রাণী ও পাখিদের জন্য বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, বাড়ির সামনে পথের ধারে কিংবা আঙিনায় পানি পান করার ব্যবস্থা রাখুন। তাপপ্রবাহ চলাকালীন শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, শ্রমজীবী ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখুন।
আপনার মতামত লিখুন :