রাজশাহীতে এবার যে পরিমাণ আম হয়েছে, তাতে লোকসান কাটিয়ে লাভের আশা করছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সেই আশা নিয়েই চাষিরা এখন গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
জেলা প্রশাসকের ঘোষণা অনুযায়ী, ১৫ মে থেকে দেশি (গুটি) জাতের আম বাজারজাত করতে পারবেন চাষিরা। তবে আম পরিপক্বতা পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন আমচাষিরা। ফলে আমকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের আমের সুখ্যাতি দেশ-বিদেশের সবখানেই। প্রতিবছর আমের মৌসুম এলে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। ইতিমধ্যে ব্যবসা সফল এই ফলের কদর দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এবার আমের ফলন ভালো হওয়ায় কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার আমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মের অনলাইন ব্যবসায়ী। তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
গত মৌসুমে গাছে আম কম আসার কারণে রাজশাহীর আমের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ে। কিন্তু এবার গাছে ভালো আম আসায় বুকভরা আশা নিয়ে এগোচ্ছেন তারা। আমের ব্যবসা ভালো হবে সে অপেক্ষায় রয়েছেন। আমের মৌসুমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রতিদিন বিশেষ ট্রেন, কুরিয়ার, পরিবহনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ অঞ্চল থেকে কয়েক শত কোটি টাকার আম যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সুস্বাদু ও পরিপক্ব আম পরিবহনে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চালু হয় ‘ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন’। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও রপ্তানি হয় এখানকার আম। আবার সংরক্ষণের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ হিমাগার।
রাজশাহীর ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ অনুযায়ী ১৫ মে থেকে সব ধরনের গুটি জাতের আম নামাতে পারবেন চাষিরা। ২২ মে থেকে নামবে গোপালভোগ, ২৫ মে রানী পছন্দ ও লক্ষণভোগ, ৩০ মে হিমসাগর বা ক্ষীরসাপাত, ১০ জুন ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও ল্যাংড়া, ১৫ জুন আম্রপালি বা ফজলি, ৫ জুলাই বারি-৪, ১০ জুলাই আশ্বিনা, ১৫ জুলাই গৌড়মতি। এ ছাড়া সারা বছর পাওয়া যাবে কাটিমন ও বারি আম-১১ জাতের আম।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী অঞ্চলে আম আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে। সম্ভাব্য গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৬ (টন), সম্ভাব্য মোট উৎপাদন দুই লাখ ৬০ হাজার ৬ মেট্রিক টন। এ ছাড়া সম্ভাব্য মোট বিক্রি এক হাজার ৬৯৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ টাকা।
জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার বলেন, আগামী ১৫ মে থেকে সব ধরনের গুটি আম পাড়তে পারবেন চাষিরা। যদি কোনো ধরনের দুর্যোগ হয়, সে ক্ষেত্রে চাষিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে আগাম আম পাড়তে পারবেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বাজারে নিরাপদ, বিষমুক্ত ও পরিপক্ব আম নিশ্চিত করতে ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ প্রণয়ন করা হয়েছে। আম নামানোর নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে, এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গাছ থেকে আম সংগ্রহ করতে হবে সবাইকে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি মৌসুমে বিভাগের নওগাঁয় ৩০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বাগানে চার লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তিন লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন ও রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর বাগানে দুই লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু জানান, বিভাগের আটটি জেলায় যে পরিমাণ আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আমকে ঘিরে রাজশাহীতে প্রচুর মৌসুমি উদ্যোক্তা তৈরি হয়। অনলাইন ও অফলাইনে তারা আম বিক্রির কাজ করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজশাহী থেকে আম বাজারজাত করা হয়। এবারও সেই বাণিজ্য যেন জমে ওঠে, সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই।
রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যায় আমের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। তাই এখন বাগানের যত্ন নিতে হবে। তবে খরায় যেন আম ঝরে না পড়ে, সে জন্য বাগানে নিয়মিত সেচ দেওয়ার পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।
মহানগরীর কোর্ট এলাকার আম ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, এবার আমগাছে ভালো মুকুল আসায় প্রথম থেকেই চাষিরা গাছের পরিচর্যা করেছেন। যার কারণে ফলনও ভালো হয়েছে। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকায় তেমন একটা ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। এ কারণে এবার আমের দামও ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি।
বাঘার আম ব্যবসায়ী মানিক, রাশিদুল ও ইয়াকুব আলী জানান, গত বছর ভরা মৌসুমে লখনা জাতের আম ৬০০-৮০০ টাকা মণ (৪০ কেজি) দরে এবং হিমসাগর দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি, ফজলি ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা বেচাকেনা হয়েছে। এবার গরমের মধ্যে আম নামাতে পারলে দামও ভালো পাওয়া যাবে। তা ছাড়া, গত বছরের তুলনায় গাড়িভাড়াসহ আনুষঙ্গিক জিনিসের দামও বেড়েছে। এ কারণে বাজারেও বাড়তি দামে আম বিক্রি করতে হবে।
আড়তদাররা বলছেন, চলতি মৌসুমের শুরু থেকে আমের জন্য অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করায় এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। সেই হিসেবে বাজারে আমের আমদানিও ভালো হবে। তবে বাইরে থেকে পাইকার কম এলে দামও কম হতে পারে।
জেলার দুর্গাপুর উপজেলার শাহবাজপুর এলাকার আমচাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, বাগানগুলোতে সঠিক পরিচর্যা করায় এবার আমের গুণগত মানও ভালো। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে চাষিরা দাম অনেক কম পান। এবার এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠে লাভবান হবেন বলে আশায় রয়েছেন তিনি।
বানেশ্বর বাজারের আড়তদার বজলুর রহমান জানান, গত বছর প্রথমদিকে আমের বাজার ভালো ছিল। এবার এখনো বাজারে আম আসেনি। আশা করছি, ১৫ মে থেকে আম বাজারে আসবে। তখন থেকে টানা তিন মাস বাজার গরম থাকবে। তবে যারা বিভিন্ন বাগান থেকে আম কিনে বাজারে বিক্রি করেন, তারা বেশি লাভবান হচ্ছেন।
ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনে ঢাকায় যাবে আম
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুস্বাদু ও পরিপক্ব আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। স্বল্প খরচে আম পরিবহনে এই ট্রেন কার্যকর। কেজিপ্রতি মাত্র ১ টাকা ১৭ পয়সা খরচে এই ট্রেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী হয়ে ঢাকায় যায় আম। যেখানে কুরিয়ারে ঢাকায় আম পাঠাতে খরচ হয় কেজিপ্রতি ১২ টাকা।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক আবদুল করিম জানান, ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনে রাজশাহী থেকে কেজিপ্রতি মাত্র ১ টাকা ১৭ পয়সা খরচে আম ঢাকায় যায়। এবারও এই ট্রেন চালু হতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে খরচ পড়ে কেজিপ্রতি ১ টাকা ৩০ পয়সা। এই ট্রেনে কোনো যাত্রী পরিবহন করা হয় না। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো এই ট্রেন চালু করা হয়েছিল। প্রথম বছর চাষি ও ব্যবসায়ীদের মাঝে সাড়া পাওয়ায় গত বছরও ট্রেনটি চালু করা হয়। প্রতিদিন ট্রেনটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুপুর ২টায় ছেড়ে রাজশাহী পৌঁছে ৫টা ২০ মিনিটে। আম উঠানোর পর ৫টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়।
এ ছাড়া রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে। এই ট্রেনে স্বল্প ভাড়ায় প্রতিদিন উত্তরাঞ্চলের আমসহ অন্যান্য ফল এবং কাঁচামাল ঢাকায় পৌঁছানো হয়।
বিদেশেও যাচ্ছে রাজশাহীর আম
রাজশাহীর আম বিদেশেও যাচ্ছে। গত বছর জেলার বাঘা উপজেলা থেকে যুক্তরাজ্যে রপ্তানির জন্য ৩০০ টন আম ঢাকায় পাঠানো হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান জানান, গত বছর বাঘা থেকে প্রায় ৩০০ টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। এবারও আম পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
২০১৯ সালে প্রথম রাজশাহীর আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তিনি আরও বলেন, রাজশাহী জেলায় উৎপাদিত আমের অর্ধেক উৎপাদন হয় বাঘা উপজেলায়। এখানে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়।
আম সংরক্ষণে হিমাগার
রাজশাহী অঞ্চলের আম সংরক্ষণে গড়ে উঠছে হিমাগার বা কোল্ডস্টোর। বিভাগে দুটি আম সংরক্ষণের হিমাগার গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে হিমাগার দুটির কাজ চলমান। এর একটি হচ্ছে রাজশাহীর পুঠিয়ার শিবপুরে এবং অপরটি নাটোরের আহম্মদপুরে। রাজশাহীর শিবপুরহাট ও নাটোরের আহম্মদপুরে এই দুটি হিমাগার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :