রবিবার, ০৩ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ওমর ফারুক

প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৫, ১২:৫২ পিএম

জুলাইয়ের গল্প

সবুজ জামায় লাল বোতাম

ওমর ফারুক

প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৫, ১২:৫২ পিএম

ইলাস্ট্রেশন : শরীফুল ইসলাম

ইলাস্ট্রেশন : শরীফুল ইসলাম

এক 
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শাহরিয়ার। গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকায় এসে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রথমে কার্য সহকারী পদে কয়েক বছর কাজ করার পর প্রমোশন পেয়ে হয় উপসহকারী প্রকৌশলী। চার ভাই এক বোনের সংসারে শাহরিয়ার বড়।

কর্মজীবনে তার বাবা ছিলেন, অসম্ভব সৎ মানুষ। একজন সৎ মানুষ হিসেবে এলাকায় শাহরিয়ারের বাবার বেশ সুনামও ছিল। নিজেদের গ্রাম তো বটেই আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ এসে বিশ্বাস করে শাহরিয়ারের বাবার কাছে তাদের জমির দলিলসহ মূল্যবান জিনিসপত্র গচ্ছিত রেখে যেতেন। গ্রামের যেকোনো দরবার-সালিসে তার বাবা ছিলেন বিচারক।

যে বেতন পেতেন, তা দিয়েই পরিবারের সবার চাহিদা মিটিয়ে সাহায্য করতেন গ্রামের বিভিন্ন দুস্থ মানুষদের। কারো ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে কিন্তু ফরম ফিলাপের টাকা নেই, শাহরিয়ারের বাবার ছিল তাদের ভরসা। নানা মানকিব কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার বাবা। শাহরিয়ারও তার বাবার স্বভাব পেয়েছে। মাস্টার্স শেষ করে শাহরিরার ঢাকাতেই আছে।

টিউশনি করে চলছে আর বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরির জন্য নিয়মিত আবেদন করছে। বেশির ভাগ পরীক্ষায় পাসও করে সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুষের কাছে হার মানে শাহরিয়ার। তার রেজাল্ট ভালো তার ওপর বাবা মুক্তিযোদ্ধা, তার পরেও ঘুষের দেয়াল সামনে এসে দাঁড়ায় তার। সে হেরে যায় কিন্তু হাল ছাড়ে না।

এক মঙ্গলবারের দুপুরে শাহরিয়ারকে ফোন করে তারা বাবা- 
হ্যালো, কেমন আসিছ বাবা?
ভালো বাবা, তোমার কী খবর? তুমি কি অফিসে?
না, বাবা। আমি বাসায়। 
আজ এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসছো কেন?
শরীরটা একটু খারাপ। তাই চলে এলাম। 
আমি কি বাড়ি চলে আসবো? 
না, বাবা। আমার শরীর ঠিকই আছে একটু জ্বর আসছে বোধ হয়। তুই চিন্তা করিস না বেশি খারাপ লাগলে আমি টেলিফোন করব তোকে। 
শাহরিয়ারের বাবার পক্স উঠেছে। প্রতিদিনই এক-দুইবার বাবার সঙ্গে কথা হয় শাহরিয়ারের। বাবা তাকে বলে ঠিক হয়ে যাবে, সে যেন চিন্তা না করে। আগের দিন রাতের বাবার সঙ্গে কথা বলে ঘুমাতে যায় শাহরিয়ার। সকাালে ঘুম ভাঙে তার ছোট বোনের ফোন পেয়ে। ঘুম ঘুম চোখে শাহরিয়ার ফোন রিসিভ করতেই তার বোনের ভারি কণ্ঠ। ভাইয়া বাবা তোকে দ্রুত গ্রামে আসতে বলছে।

শাহরিয়ার আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। মেসের অন্য সদস্যদের বলে বেরিয়ে যায় বাড়ির উদ্দেশ্য। সে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার বাবা চলে যায় না ফেরার দেশে।

বাবা মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই শাহরিয়ারের কাঁধে ভর করে বিশাল দায়িত্ব। বোনের বিয়ে। ছোট ছোট তিন ভাইয়ের পড়াশোনা। বাবার পেনশনের টাকা উত্তোলন। মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে শাহরিয়ার। এক দিন মাকে নিয়ে যায় তার বাবার অফিসে। শাহরিয়ারের বাবার চাকরির শেষ কয়েক বছর কেটেছে তাদেরই উপজেলায়। উপজেলার প্রধান প্রকৌশলী ছিল তার বাবার বস। শাহরিয়ারের মা খুব অনুরোধ করে যেন শাহরিয়ারের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তিনি। মায়ের আত্মবিশ্বাস ছিল তার বাবা যেহেতু সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা তাই সঠিকভাবে চেষ্টা করলে শাহরিয়ারের একটি চাকরি হবেই। 

শাহরিয়ারের মায়ের মুখে এই কথা শুনে ওই অফিসা তাকে কিছুই বললেন না। ওই কর্মকর্তা তাকে পাশে ডেকে বলেন, 
-বাবা, তোমার জন্য আমরা বিশেষ সুপারিশ করবো। তবে... তুমি তো জানো, ভালো চাকরি পেতে হলে কিছু খরচা-পাতি করতে হয়। 
শাহরিয়ার কিছু বলছে না, শুধু নির্বাক ছিল।

লোকটি আবার বললেন, 
-তবে তুমি অত চিন্তা কোরো না। তুমি আমার কলিগের ছেলে। তোমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তা ছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তোমাকে চাকরির ব্যবস্থা আমি করে দিবো। আমি কথা দিলাম, অন্যদের খরচের তুলনায়, তোমার অর্ধেক খরচেই কাজ হয়ে যাবে।
এর আগে অনেক সরকারি চাকরি হয়নি শাহরিয়ারের। শুধু ঘুষ দিতে পারেনি বলে। সেই সময় শাহরিয়ার হেরে গেলেও হাল ছাড়েনি। কিন্তু এবার তার সরকারি চাকরির ওপর একটা ঘৃণা চলে এলো। সে শপথ করলে বেঁচে থাকতে, সে আর সরকারি চাকরি করবে না। 


দুই. 
একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নেয় শাহরিয়ার। গাড়ি বাড়ি দেয়নি তাকে। তবে ভালো বেতন। এরই মধ্যেই সে তার বোন কে বিয়ে দিয়েছে। ভাইদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রেমিকা ফারজানাকে বিয়েও করেছে। তাদের ফুটফুতে একটা মেয়ে হয়েছে। তার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তার প্রথম নাতি কিংবা নাতনি যাই হোক না কেন তার নাম হবে মুক্তি। শাহরিয়ার বাবার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। মুক্তি এখন ক্লাস টু-তে পড়ে। বাবা-মায়ের চোখের মণি। অদ্ভুত কৌতূহলী মেয়ে, সারা দিন সবাইকে নানা রকম প্রশ্ন করে যায়। শাহরিয়ার কখনো বিরক্ত হয় না, ধৈর্য নিয়ে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়। বিশেষ করে এখন আরও বেশি বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে তাকে। কারণ সারা দেশে ছাত্র আন্দোলন চলছে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। তাই বাসায় বসে মুক্তি সঙ্গেই দিন কাটছে তার। এরই মধ্যে তার দাদি ফোন দেয়।

মুক্তি তারা বাবার কাছ থেকে ফোন নিয়ে দাদিকে বলে-
জানো দাদি, আমাদের এখানে না গ-গল হইতাছে। তুমি আমাকে গ-গলের গল্প শুনাই ছিলা না? দাদাভাই সেই গ-গলে যুদ্ধ করছে। 
মুক্তির মুখে এই কথা শুনে তারা বাবা, মা এবং দাদি সবাই অবাক। এ কথা মুক্তি কীভাবে বললো। তখন তার দাদি বললো, আরে মুক্তিকে যুদ্ধের গল্প শোনাতে গিয়ে আমিই বলেছিলাম।   


তিন.
ছাত্র আন্দোলন তখন চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে ছাত্রদের এই আন্দোলন। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণেই শাহরিয়ার শুরু থেকে এই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। এ নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে বেশ সরব সে। এরই মধ্যে সে ছাত্রদের পক্ষে লেখালেখির কারণে উড়ো হুমকিও পেয়েছে। সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ দেয় সরকার। ছাত্রদের আন্দোলন দমনে চালায় গণহত্যা। বিভিন্ন গণমাধ্যমও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে হোঁচট খায়। তাদের যা প্রচার করতে বলা হয়, তারা তাই প্রচার করে। সাধারণ জনতাকেও সেটাই বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু আসল সত্যিটা কেউ জানতে পারে না। ঢাকার রাস্তায় কারফিউ, বাইরে বের হওয়া নিষেধ। মুক্তি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে।

এক দিন খেতে বসে মুক্তি তার বাবাকে বলে,
-বাবা, আন্দোলন কী? ছাত্ররা কেন রাস্তায় নেমেছে? পুলিশ তাদের মারছে কেন?
শাহরিয়ার থমকে যায়। মনে মনে ভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর তো আমার কাছে নেই মা!
-আন্দোলন মানে অন্যায়ের প্রতিবাদ। বুঝলি মা, একদল মানুষ অন্যায়ের সুযোগ নেয়। যখন সমাজে অতিরিক্ত অন্যায় হয়, তখন মানুষ প্রতিবাদ না করলে অন্যায় বাড়তেই থাকে।
-বাবা, তুমিও কি আন্দোলন করো?
শাহরিয়ার হাসে।
-বাবা তো অফিস করে মা, আন্দোলন কখন করবে!
মুক্তি ভ্রু কুঁচকে ভাবে।
-কিন্তু তুমি তো অন্যায় পছন্দ করো না, তাই না? তাহলে তুমি কেন আন্দোলন করো না?
শাহরিয়ার এবার কিছু বলে না। ছোট্ট মেয়েটার সরল প্রশ্ন তার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা এনে দেয়। সে তো তার জায়গা থেকে যতটুকু পারছে করছে। যদি সত্যিই যোগ্যদের মূল্য দেওয়া হতো, তাহলে কি তার জীবনটাও অন্য রকম হতে পারত?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই মুক্তির মন চলে যায় অন্যদিকে।
-বাবা, আমি একদিন আন্দোলন করব! দেখো! দাদু ভাইয়ের মতো যুদ্ধ করব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো। 
শাহরিয়ার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, 
আচ্ছা, যখন বড় হবে তখন দেখা যাবে। এখন নিয়মিত পড়াশোনা
করো। মেয়ের এমন কথায় শাহরিয়ারের বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে ওঠে। এমন একটা সাহসী সন্তানই তো সে চেয়েছিল।   


চার. 
ছাত্র আন্দোলন আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। মূলত রাষ্ট্রপ্রধানের এক বক্তব্য ছাত্রদের মনে জ্বলতে থাকা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। সেই আগুন এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। রাস্তায় রাস্তায় চলছে জনমানুষের বিক্ষোভ। তাদের একদফা।

স্বৈরাচার সরকারের পতন।  আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেছে সরকার। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছে, তবু খবর ছড়িয়ে পড়ছে। সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছাত্ররা রাস্তায় নামছে।

সবখানে চলছে গোলাগুলি। টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে ছাত্ররা এখন সরকারের পতন চায়। দেশজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। 
সরকারও ছাড় দিচ্ছে না। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ওপর আদেশ রয়েছে, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন প্রতিরোধ করে ক্ষমতায় থাকতে হবে। সরকারের পোষা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দিল্লির ও বাহিনী। হেলিকাপ্টারে করে ওপর থেকে ছোড়া হচ্ছে গুলি।  
মুক্তির জন্য সময় কাটানো কঠিন হয়ে গেছে। বাবা-মা সবসময় পাহারা দেয়, বাইরে বেরোনো তো দূরের কথা, বারান্দায় যাওয়াও নিষেধ।

স্কুল বন্ধ, খেলার সঙ্গী নেই। সে দিন গুনতে থাকে। কবে এ গ-গোল থামবে। সে আবারও স্কুলে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলবে। আইসক্রিম খাবে। ছুটির দিনে বাবার সঙ্গে পার্কে বেড়াতে যাবে। সে পরিকল্পনা করে রেখেছে, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যাবে দূরে কোথাও। মুক্তি আজ সারা দিন স্কুল ড্রেস পরে আছে। সবুজ রঙের স্কুল ড্রেস তার।  
নিজের পোষা বিড়াল মিনুকে খুঁজতে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় সে।

শাহরিয়ার ড্রইং রুমে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিল। আর ফারজানা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। ফারজানা বলে উঠলো,
-মেয়েটার ঘুম ভেঙেছে মনে হয়, দেখো তো!
শাহরিয়ার বলে,
- একটু অপেক্ষা করো, অফিসের কাজটা শেষ করি।
ফারজানা বিরক্ত হয়,
-কাজ আর শেষ হয় না তোমার! 
তখনই মুক্তির গলা শোনা যায়,
-মিনু! মিনু!
ফারজানা মেয়ের নাম ধরে ডাকে,
-মুক্তি! মা! এদিকে আসো! 
মিনুকে কোলে নিয়ে মায়ের কাছেই যাবে, কিন্তু মুক্তি শুনতে পায় বিশাল বিকট শব্দ। বারান্দার গ্রিল ধরে সে আকাশের দিকে তাকায়। দক্ষিণের আকাশে সব বিল্ডিংয়ের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারটা ঠিক তার দিকেই উড়ে আসছে। মুক্তি উৎফুল্ল হয়ে যায়! তার দুই চোখে আনন্দ ভেসে ওঠে। অনেক দিন মুক্ত পাখি দেখেনি সে। এই হেলিকপ্টারকে বিশাল কালো কাকের মতোই মনে হচ্ছে তার। মনের সুখে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে এই কাক। তার মনে পড়ে যায় বন্ধু অহনার কথা। অহনার কাক অনেক প্রিয় শুধু কালো রঙের জন্য। আজ অহনা এখানে থাকলে খুব খুশি হতো। আন্দোলন থামলে, স্কুল খুলবে। তখন অহনাকে এই কথা বলবে ঠিক করে রাখলো সে। হেলিকপ্টার আরও কাছে আসতেই সে ডেকে উঠল,
-বাবা! বাবা! দেখো! কত্ত বড় পাখি উড়ছে!
বাবা তার ডাক শুনতে পেল কি না, কে জানে! তখনই হঠাৎ হেলিকপ্টারের দরজায় আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেল সে। আলোর চেয়ে শব্দের গতি কম, তাই হয়তো এক সেকেন্ডের কিছু কম সময় পর হেলিকপ্টারের শব্দ ছাপিয়ে আরও জোরালো শব্দ শুনতে পায় মুক্তি। আশপাশে তাকায়। শব্দ শুনতে পেয়েছে ফারজানা আর শাহরিয়ারও। শাহরিয়ার ল্যাপটপ ফেলে দৌড় দেয়, ফারজানাও পাগলের মতো ছুটে আসে।

মুক্তির চোখে সময় যেন ধীরে চলতে শুরু করে। সে স্পষ্ট দেখতে পায়, একটা লাল আলো সোজা তার দিকে এগিয়ে আসছে।
তারপর...
মুক্তির ছোট্ট বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্য হয়ে যায়। যেন কেউ খুব শক্ত করে ধাক্কা দিলো।
পেছনের দেয়ালে বারি খেয়ে, মুক্তির দেহ ঢলে পড়ে বারান্দার মেঝেতে। তার সবুজ জামায় একটা লাল গোল দাগ ফুটে ওঠে। দেখে মনে হয় যেন, সবুজ জামায় লাল বোতাম। বাবা-মা একই সঙ্গে বারান্দায় প্রবেশ করে। এক সেকেন্ড স্তব্ধতা। তারপর ফারজানা আর শাহরিয়ারের গগণ বিদারী চিৎকার। শাহরিয়ার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ডাকে,
-মুক্তি! মুক্তি মা!
কোনো সাড়া নেই।
শাহরিয়ারের স্নায়ু অনেক বেশি সচেতন; তাই মস্তিষ্ক সংকেত দিচ্ছে, এখন হাসপাতালে যেতে হবে। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে লিফটের দিকে দৌড়ে যায়। ফারজানা কখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে, সেটা তার খেয়ালে নেই।
বাসার নিচে পৌঁছেই শাহরিয়ার চারদিকে তাকায়। কোনো গাড়ি নেই।
সে পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে।
বড় রাস্তায় আসতেই পুলিশ তার পথ আটকায়। তারা বলে,
-কোথাও যেতে পারবেন না! কারফিউ চলছে!
শাহরিয়ার কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-আমার মেয়ে মরে যাচ্ছে! প্লিজ!
পুলিশরা উদাসীন। শাহরিয়ার অনেক অনুরোধ করার পরেও তারা মুক্তিকে হাসপাতালে নিতে দেয় না।
শাহরিয়ারের কোলে মেয়ের নিথর দেহ। সে বোঝে...সব শেষ হয়ে গেছে। কোনো হাসপাতাল, কোনো ডাক্তার, কেউ আর তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সে ধিক্কার জানায় দেশের জঘন্য সিস্টেমের প্রতি।
মুক্তির সবুজ জামায় যে লাল দাগ, সেটা বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
সেটা কি রক্ত?
নাকি... নাকি আসলেই লাল বোতাম?


পাঁচ. 
পরদিন ৫ আগস্টেও সকাল। নতুন সূর্যে আলোকিত চারপাশ। কিন্তু শাহরিয়ার ও ফারজানার দুনিয়ায় কোনো আলো নেই। রাষ্ট্রের পরিস্থিতি তখনো থমথমে। আজ চূড়ান্ত কিছু একটা হবে। দেশের আপমর জনতা যাচ্ছে গণভবনের দিকে। শাহরিয়ার আর ঘরে বসে থাকতে পারল না। সেও পা চালালো গণভবনের উদ্দেশে। একটু পরেই খবর আসে ছাত্র-জনতার সুনামিতে ভেসে গেছে খুনি, স্বৈরাচার সরকারের গদি। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে সে। উল্লাসে ফেটে পড়েছে দেশের মানুষ। যে উল্লাস আর উচ্ছ্বাস দেখছে গোটা বিশ্ব। 

লাল-সবুজের পতাকা মাথায় বেঁধে বিজয়ীর বেসে বাসায় ফিরে শাহরিয়ার। তাকে জড়িয়ে ধরে ফারজানা কাঁদতে কাঁদতে শাহরিয়ারকে বলে, 
-একটা দিনের জন্য ওকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না।
শাহরিয়ার তাকে এবং নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, আজ তো আমাদের জীবনে দুটি সূর্য উদিত হলো ফারজানা। এমন ভাগ্য কজনের হয় বলো? আমাদের মুক্তি জ্বলজ্বল করে হাসবে ওই আকাশে। 

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!