বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ নতুন রেকর্ড গড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুন শেষে ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ৮১ বিলিয়ন ডলার। সরকারের সর্বশেষ এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, জুন মাসে সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি ও জাইকা থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ গ্রহণ করে। এ কারণে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ রেকর্ড মাত্রায় বেড়েছে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ডলারের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ১২২ টাকায় পৌঁছে যায়। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও রিজার্ভের পতন থামেনি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুটা স্থিতিশীলতা আসে। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হয় এবং প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নত করতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ ছিল ৮৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ তিন মাসে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ সামান্য কমে ১৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, বৈদেশিক ঋণের বেশিরভাগই সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া। তিনি সতর্ক করে বলেন, অতীতে অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণের অপচয় হয়েছে। সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে ভবিষ্যতে পরিশোধের চাপ বেড়ে যাবে।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, জিডিপি অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
২০০৬ সাল শেষে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে ঋণ বেড়ে ২০০৮ সালের শেষে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ ৩৯ শতাংশ বেড়ে ২০১৩ সালের শেষে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে।
২০১৪ সালে আবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরবর্তী পাঁচ বছরে (২০১৪-১৮) ঋণ দ্রুত বাড়ে এবং ২০১৮ সালের শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার।
টানা তৃতীয় মেয়াদে (২০১৯-২৩) আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ঋণ দাঁড়ায় ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৪ সালের শুরুতে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ছয় মাসে আরও প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয় সরকার। সরকারের পতনের সময় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন