পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারির মূলহোতা

ঋণখেলাপির জনক সালমান এফ রহমান

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৪, ০৮:৩৭ পিএম

ঋণখেলাপির জনক সালমান এফ রহমান

সালমান এফ রহমান। ছবি: সংগৃহীত

সালমান এফ রহমান; পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতে একটি আতঙ্কের নাম। প্রথম ১৯৯৪-৯৫ সালে ১০ বছর মেয়াদে চারটি ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা নিয়েও লভ্যাংশ দেননি। এরপরে তিনি আলোচনায় আসেন জিএমজি এয়ারলাইন্স নিয়ে। বিমান বাংলার আকাশে উড়াল দিলে আশায় বুক বেঁধে ৩শ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনেন বিনিয়োগকারী। দীর্ঘ সময়েও সেই টাকা ফেরত না পাওয়ায় মামলা হলে আদালতে গিয়েও সুরাহ মেলেনি।

অন্যদিকে, সরকারের ছত্রছায়ায় বেক্সিমকো কোম্পানির নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা ঝুলছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ছিলেন ছিলেন তিনি। যার কারণে সুকুক বন্ডের নামে দেশের ব্যাংকগুলোকে বেক্সিমকোতে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনয়োগে বাধ্য করেন। সর্বশেষ চলতি বছরে পুঁজিবাজার থেকে আরো আড়াই হাজার কোটি টাকার নেওয়ার চেষ্টা করেন সালামান এফ রহমান। প্রবল জনস্রোতের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে তার সব চেষ্টাই বিফলে যায়।

তখন গুঞ্জন ছিল মন্ত্রী পদমর্যাদার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প উপদেষ্টাও ভারতে পালিয়েছেন। সেই তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে গত মঙ্গলবার। ঢাকার সদরঘাটে নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে দেশের ঋণখেলাপির এই জনকসহ আটক হন সাবেক আইনমন্ত্রী আইনসুল হক। তাদের দুজনকে আইনের আওতায় নিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুন করেন আদালত। সালমান এফ রহমানকে মঙ্গলবার আটক করার পরই তার ছেলে শায়ানেরও কাপাল পোড়ে। ঋণখেলাপির দায়ে আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে এফ রহমান আটক হওয়ায় অনিশ্চতায় পড়েছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় বেক্সিকো গ্রুপটি। পুঁজিবাজার ও ব্যাংকখাত নষ্টের মূলে তাকে অভিহিত করেন অনেক বিনিয়োগকারী।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ছিলেন সালমান এফ রহমান। নানা রকমের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকলে সরকারের মেয়াদে তিনি বেশ ভালো চিলেন। তবে আওয়ামী সরকারের পতনের পরে দোকানের একজন কর্মচারীকে হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শেয়ার বাজার ও ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারির মূলহোতাদের একজন হিসেবে তার নাম গত ১৫ বছর ধরে বরাবরই আলোচনায় ছিলেন তিনি।

অনেকেই সালমান এফ রহমানকে বাংলাদেশের ঋণখেলাপির জনক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। সালমান দোহারের সংসদ সদস্য এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। একইসঙ্গে আইএফআইসি ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান এবং অনেক ব্যবসায়ী সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদেও তিনি অধিষ্ঠিত।

আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান। ছবি: সংগৃহীত

কোম্পানি আইন বদল 
১৯৭২ সালে কমোডিটি ট্রেডিং কোম্পানি হিসেবে সালমান ও তার বড়ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো কোম্পানি বিভিন্ন সময় ঋণ খেলাপি হয়। পরে ঋণ পুনঃতফসিল করতে নতুন নিয়ম তৈরি বা সংশোধন করতে নিয়ন্ত্রকদের বাধ্য করেন তিনি। এর মাধ্যমে আদালতের আদেশের বিপরীতে নিজেকে সুরক্ষিত করেছিলেন তিনি। এর পরে ২০১৪ সালের আগস্টে তারল্য সংকটের কারণ দেখিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া বেক্সিমকোর ঋণ পুনঃতফসিল করেন সালমান এফ রহমান।

কোম্পানিটি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিনিষেধ, পূর্ববর্তী তিন বছরে ৮০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ এবং ২০১৩-১৪ সালে দীর্ঘ অবরোধ ও শাটডাউনের কারণে ঘটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে দায়ী করেন। সে সময় সাতটি ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এরপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া এক চিঠিতে বেক্সিমকো টিকে থাকতে জরুরি ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের আহ্বান জানায় গ্রুপের চেয়ারম্যান।

২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন বড় ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করে, যার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণগ্রহীতাদের আবেদন গ্রহণ করে। প্রায় ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ওই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের খেলাপি ঋণের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে। সেই সময় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, এই অর্থের এক-তৃতীয়াংশই পুনর্গঠন করেছে বেক্সিমকো।

ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও সুবিধা আদায়
ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণদাতারা ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এতে যে বেক্সিমকো বিচলিত হয়নি, সেটা তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায়। কারণ হিসেবে, নীতিমালার আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ১২ বছর মেয়াদে ১০ শতাংশ সুদে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকোর এক হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে, যা তখনকার ১৩-১৪ শতাংশ সুদের হারের চেয়ে অনেক কম।

ঋণ খেলাপি হলেও মামলা করেনি সোনালী ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তে বেক্সিমকো বিচলিত হয়নি, এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ঋণগ্রহীতার প্রতি প্রান্তিকে সোনালী ব্যাংককে ৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঋণগ্রহীতার ছয় কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেক্সিমকো দিয়েছে মাত্র দুটি কিস্তি। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে তা খেলাপিতে পরিণত হয়। এরপরেও সোনালী ব্যাংক প্রদত্ত সুবিধা প্রত্যাহার করেনি এবং বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে মামলাও করেনি। এর পরিবর্তে ২০১৮ সালের মার্চে আবারও বেক্সিমকোকে দেওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য খেলাপি ঋণের ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট বাধ্যতামূলক হলেও তা করতে বেক্সিমকোকে কোনো ডাউন পেমেন্ট করতে হবে না।

জিএমজি এয়ারলাইনসের শেয়ার বিক্রি
পুঁজিবাজার লুটের আরেকটি উদাহরণ হলো জিএমজি এয়ারলাইনস। ১৯৯৮ সালে জিএমজি এয়ারলাইন্স আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৪ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক রুটেও ফ্লাইট শুরু করে। পুঁজিবাজারে আসার কথা বলে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান।

এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য ২০১৬ সালের আগস্টে সালমান ও তার ভাই সোহেলের সম্পত্তি নিলামে তোলার জন্য সোনালী ব্যাংক উদ্যোগ নিলেও পরে অদৃশ্য কারণে বন্ধ করা হয়।

২০০৯ সালে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে জিএমজি। এতে ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারের সঙ্গে ৪০ টাকা প্রিমিয়ামসহ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা নেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাজার থেকে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ১৬৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের প্রতিষ্ঠানটি আইপিওর (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ আরও ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহের আবেদন করে। কিন্তু কোম্পানির আর্থিক রিপোর্টে জালিয়াতি ধরা পড়ায় ২০১২ সালে আইপিও আবেদনটি বাতিল করে বিএসইসি। নিয়ম অনুসারে আইপিও আবেদন বাতিল হলে প্লেসমেন্টের টাকা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিতে হয়। কিন্তু সেই টাকা আটকে রেখেছে জিএমজি।

এরপরে জিএমজির অর্ধেক শেয়ার কিনে নেয় বেক্সিমকো। গত জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তোলার নোটিশ দিলে জিএমজি হাইকোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেয়।

বিধ্বস্ত ডিবেঞ্চার মার্কেট
নব্বইয়ের দশকে সংগৃহীত প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করায় বাংলাদেশের ঋণপত্র বাজার ধ্বংস করার অভিযোগ এখনো রয়েছে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাজারে ডিবেঞ্চার এক ধরনের ঋণ বিন্যাস, যা বৃহৎ কোম্পানিগুলো অর্থ ধার করার জন্য ব্যবহার করে থাকে।

বৃহৎ কোম্পানি হিসেবে বেক্সিমকো ১৯৯৪-৯৫ সালে ১০ বছর মেয়াদে চারটি ডিবেঞ্চার ইস্যু করে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে তাদের মেয়াদ শেষ হলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধ করা হয়নি।

গত বছর তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য সুকুক বন্ড ইস্যু করার প্রস্তুতি নেয় বেক্সিমকো। এই সময়ে বেক্সিমকোর ঋণখেলাপি ইস্যু সমালোচনার মুখে পড়ে এবং কোম্পানিটিকে পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। নির্ধারিত সময়ের ১৫ বছর পর ওই টাকা পরিশোধ করেছে সংস্থাটি।

সালমান এফ রহমান। ছবি: সংগৃহীত

সুকুক বন্ডে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে বাধ্য করা
পুঁজিবাজারের মধ্যেমে বেক্সিমকো ২০২১ সালে দেশের সবচেয়ে বড় সুকুক বন্ড ইস্যু করে। যার পরিমাণ ছিল তিন হাজার কোটি টাকা। তখন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা তিনি। তার কোম্পানির বন্ড কিনতে কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহী না হওয়ায় ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেন তিনি।

সালমান তার সুকুকে বিনিয়োগের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের চাপ দেন। তা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংক স্বল্প পরিমাণ তহবিল বিনিয়োগ করেছে। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে অন্তত দুবার বিনিয়োগের সময় বাড়াতে হয়েছে।

পুঁজিবাজারকে চাঙা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি তহবিল গঠন করে এবং ব্যাংকগুলোকে শুধু শেয়ারবাজারের জন্য পরিকল্পিত তহবিল থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেয়।

সালমান এফ রহমান ব্যাংকগুলোকে সুকুকে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে সার্কুলার জারি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করেন। এরপর সালমান কয়েকটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তার কোম্পানির সুকুকে বিনিয়োগ করতে বলেন।

সর্বশেষ চলতি বছরে পুঁজিবাজার থেকে আরো আড়াই হাজার কোটি টাকার নেওয়ার চেষ্টা করেন এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে এই অর্থগৃধনুর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!