বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়েও স্বঘোষিত বুটেক্স ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের দ্বারা শিবির ও আলবটার্স ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে দ্বিমত পোষণ করা শিক্ষার্থীদের। পুলিশ, এনএসআই-এর ভয় দেখানোসহ অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসে নানাভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে কেউ কেউ বলে দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে মুক্তি দেয় দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী স্বৈর-শাসন থেকে। এই দীর্ঘ সময়কালে বিভিন্ন কায়দায় দেশের জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা কখনো সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করলেও তাদের দেওয়া হতো জামাত-শিবির ট্যাগ। সরকারের পোষা ছাত্রলীগের দ্বারা করা হতো অমানবিক নির্যাতন।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের রাজনীতিতে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এত বছর বুটেক্সে নিশ্চিহ্ন প্রায় ছাত্রদলকে নতুন করে সচল হতে দেখা যায়। খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে এতকাল গা-ঢাকা দিয়ে থাকা স্বঘোষিত ছাত্রদলের নেতারা।
৫ আগস্টের পর হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরমধ্যে স্নাতক সম্পন্ন করা ৪২ ও ৪৩তম ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসের বুটেক্স শাখা ছাত্রদলের নেতা দাবি করেন। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় নানাবিধ মন্তব্য করে নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য খোলা ‘বুটেক্স ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন’ গ্রুপে নিজের রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন চালাতে দেখা যায়। সেখানে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে থাকা শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করায় তাদের দেওয়া হয় শিবির ট্যাগ। এমনকি ফেসবুকে তার পোস্টে ন্যূনতম ‘হাহা রিএক্ট’ করা শিক্ষার্থীদের আলবটার্স নামে আখ্যা দেন।
সম্প্রতি পুরান ঢাকায় যুবলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্মমভাবে ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন। তবে এই মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের রয়েছে বিরূপ মন্তব্য।
অভিযোগ আছে, মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের পুলিশ এবং এনএসআই-এর ভয় দেখানোরও, যা মিলে যায় স্বৈরাচারী হাসিনার আমলের ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এফ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শিবির ট্যাগিং ছিল আওয়ামী লীগের পুরোনো কালচার, যার মাধ্যমে যে কাউকে মারধর, জেলে পাঠানো বৈধতা নিয়েছিল তারা। যদিও ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো বৈধ রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন সমর্থনের অধিকার আছে। তবে তা অবশ্যই ক্যাম্পাসের ভেতরে নয় বা ক্যাম্পাসের নামে নয়। এখন এই ছাত্রদল নেতা একই সংস্কৃতি বানানোর চেষ্টায় আছে। যার সঙ্গে যুক্তি-তর্কে পারছে না, যে তার এই ক্যাম্পাসের নাম বেচে রাজনীতি করার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে, তাদেরকে শিবির-জামাত ট্যাগ দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. শাহরিয়ার আলম পাবেল বলেন, কারো সমালোচনা পছন্দ না হলে বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন করতো ছাত্রলীগ। তাদের এই ট্যাগিং-এর রাজনীতি এবং নির্যাতনের উপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের চরম ক্ষোভ আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেখেছি। বর্তমানে এসেও যদি সাধারণ শিক্ষার্থীকে তার যৌক্তিক সমালোচনার জন্য বিভিন্ন ট্যাগের শিকার হতে হয়, তাহলে সেই ট্যাগ দেওয়া ব্যক্তিও ভবিষ্যতে স্বৈরাচার হয়ে উঠবে। আমাদের এই ট্যাগিং-এর রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং সমালোচনা মেনে নিয়ে নিজেদের সংশোধন করতে হবে। ছাত্রলীগের চরম পরিণতি দেখেও যদি কারো শিক্ষা না হয়, তাহলে তার পরিণতি ছাত্রলীগের চেয়েও ভয়াবহ হবে। বুটেক্সের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ট্যাগিং-এর রাজনীতি করা ব্যক্তিদের এবং রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ট্যাগিং-এর মাধ্যমে রাজনীতি অনুপ্রবেশ করাতে চাওয়া ব্যক্তিদের শক্ত হাতে দমন করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মারুফ বলেন, গতবছরের ৫ আগস্টের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির ভিত্তিতে বুটেক্সে সকল ধরনের ছাত্ররাজনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরও কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী নিজেদের বুটেক্স ছাত্রদলের সদস্য হিসেবে দাবি করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বুটেক্সে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শিক্ষার্থীদের নামে তিনি শিবির এবং বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠনের ট্যাগ দিতে থাকেন এবং হলে বসবাসকারী কতিপয় জেলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে অপপ্রচার করতে থাকেন। রীতিমতোই এমন বিষয়গুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে এক ধরনের সংশয় তৈরি করে, যা স্বাভাবিকভাবেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত পরিবেশের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি থাকবে, এই ধরনের কার্যকলাপ যারা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিয়ে যারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে যারা অপপ্রচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ২০১৩ সালের পর আওয়ামী লীগ চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে জামাত-শিবিরকে বিতর্কিত করে ‘শিবির’ ট্যাগকে প্রোপাগান্ডা ও দমন-পীড়নের হাতিয়ার বানায়। মতবিরোধী স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরাও এ নির্যাতনের শিকার হয়, লেখকও হয়েছেন। বিশ্বজিৎ-আবরার ফাহাদ হত্যার ক্ষেত্রেও এ ট্যাগিং ব্যবহৃত হয়। ছাত্রদলের বহু কর্মী এভাবে নির্যাতিত হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরও বুটেক্সে কিছু শিক্ষার্থী মতের বিরোধীদের ‘শিবির’ ট্যাগ দিচ্ছে। গণতান্ত্রিকভাবে সবার রাজনীতি করার অধিকার থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ সংস্কৃতি ক্ষতিকর। নতুন কেউ ফ্যাসিস্ট আচরণ করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কঠোর প্রতিরোধ করবে।