ফ্যাসিবাদের পতনে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে যে ঐক্য ছিল বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপি গঠনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে, এক বছর পার না হতেই আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ভেঙেছে সেই ঐক্য। সবারই লক্ষ্য এখন যেভাবেই হোক বিজয়ী হয়ে আগামীতে সরকার গঠন করা।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যেও তাদের বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে জোর আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। এর মধ্যেই গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়েছে। না হলে গণভোটে যাওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
আগামী নির্বাচনে বিজয় নিয়ে জামায়াতে ইসলামী-এনসিপির ব্যাপক আশাবাদ ও পরবর্তী সময়ে ইসলামী আন্দোলনের পিআর পদ্ধতির নির্বাচন সবকিছু নিয়েই সন্দেহ রয়েছে দেশের অন্যতম বড় সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি)। এনসিপি এবং জামায়াত যখন ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে কিংবা সরকার গঠন করে ফেলছে, তখন বিএনপি এখনো নির্বাচন আদায় করার লড়াইয়েই ব্যস্ত সময় পার করছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, যেখানে নির্বাচন কবে হবে তারই খবর নেই, তখন তারা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছে কী করে? তবে কি পর্দার আড়ালে চলছে অন্য কিছু এমন প্রশ্ন বিএনপি নেতাদের। রাজনীতির এমন দৃশ্যপটের মধ্যেও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে দলটি। বিএনপি সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১৬ বছর পর ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা দেখছে বিএনপি। সরকার গঠনের সুযোগ যাতে কোনোভাবে হাতছাড়া না হয় সে জন্য ফেব্রুয়ারি মাসকে ধরেই সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যত্ন নিয়ে ভোটের পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন ফরম জমা দিতে গিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটওয়ারী গণমাধ্যমে বলেছেন, আগামীতে সরকার গঠন করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কোথাও বলেছেন ৩০০ আসনই পাবে এনসিপি। তাদের দয়ায় বিএনপি ৫০-১০০ আসন পেতে পারে।
একাধিক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। তার এই কথা নিয়ে নেটিজেনরা হাসাহাসি করলেও বিএনপির একাধিক নেতা বিষয়টিকে দেখছেন ষড়যন্ত্র হিসেবে। আগামী নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে এনসিপি ৩০০ আসন বাগিয়ে নিতে পারে। এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা।
অন্যদিকে পাবনার এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, মিথ্যা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মাওলানা নিজামীসহ জামায়াতের সব নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। জামায়াত কী কমেছে নাকি বেড়েছে? জামায়াত এখন ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম এবং জামায়তে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, না হলে গণভোটে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা। সমাবেশে ১০টি রাজনৈতিক দল এবং হিন্দু মহাজোটসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিনিধিও অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তাঁরা দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন। ক্লোজ ডোর বৈঠকে ঠিক কী কথা হয়েছে তা জানতে পারেনি কেউ। বিএনপির নীতিনিধারর্ণী পর্যায়ের নেতারা ধারণা করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার যমুনায় এই বৈঠকে সিইসিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর কথা বলবেন; কিন্তু সরকারের দিক থেকে এই বৈঠককে শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হয়েছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনও কোনো বক্তব্য দেয়নি।
ফলে বিএনপি মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সিইসিকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি। যার ফলে প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির সাক্ষাতে কী আলাপ হয়েছে, তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানায় বিএনপি।
এ বিষয়ে গত শুক্রবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি উভয় পক্ষ থেকে জাতির সামনে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হই।’
প্রসঙ্গত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল লন্ডন বৈঠকের পর সেটা কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছিল; কিন্তু বৈঠকের পর দুই সপ্তাহ পার না হতেই নতুন করে নির্বাচন নিয়ে ফের সংশয় তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। বিশেষ করে ভোটের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেওয়ায় এ নিয়ে বাড়ছে জল্পনাকল্পনা।
বিএনপি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন নির্বাচনের কমিশনের কার্যক্রমে তারা দেখছেন না। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ কিছু বিষয় নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এটাকে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন আনুপাতিক পদ্ধতির নামে নির্বাচন পেছাতে মাঠে নেমেছে একটি পক্ষ। নির্বাচন বাধাগ্রস্ত না করে দেশের স্বার্থে আবারও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান তিনি। তিনি বলেন, যে যা-ই বলুক, বিএনপি অনেক ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। সেই সুযোগে মাত্রাতিরিক্ত অন্যায় আবদার করছে কিছু রাজনৈতিক দল। বিএনপি যা চাইবে তাই বাস্তাবায়ন হবে বলেও আশা তার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। যারা আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন বিলম্ব অথবা নির্বাচন বানচাল করা। তারা জানে, নির্বাচনে গেলে কারা কয়টা আসন পাবে, তাই নির্বাচনে অনীহা তাদের। যত দেরি হবে ততই তাদের লাভ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ যাতে কোনোভাবে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যত্ন নিয়ে নির্বাচনী পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে ইশতেহার রচনা, প্রচারসহ সব ক্ষেত্রেই সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নিতে চান তাঁরা। এর অংশ হিসেবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে নাকি জোটগতভাবে নির্বাচন করবে, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতে পারে, এমনটা ধরে নিয়েই নির্বাচনী যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ জন্য যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে নতুন করে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করার কথা বলা হচ্ছে। তবে সেটা কোন কাঠামোতে হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। বিএনপির সঙ্গে বিগত দিনে যুগপৎ আন্দোলন করেছে এমন দলগুলোকে নিয়ে জোট হবে, নাকি তাদের জন্য আসন ছাড় দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে যে দলগুলো একাত্ম হয়ে বিগত দিনে আন্দোলন করেছে, নির্বাচন বর্জন করেছে, তাদের অবদানের প্রতিদান দিতে চায় বিএনপি। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নির্বাচনি ইশতেহার রচনার ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই ৩১ দফার আলোকেই নির্বাচনি ইশতেহারও করা হবে। এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হাইকমান্ডের নির্দেশে প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি দল গোছানো, শৃঙ্খলা আনয়নসহ বিএনপিতে বিভিন্ন প্রস্তুতি চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এবার খুবই কঠোর অবস্থানে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলের দুঃসময়ে পাশে ছিলেন না, আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় ছিলেন কিংবা গা বাঁচিয়ে বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপস করে চলেছেন, এমন নেতাদের প্রার্থী করা হবে না এবার। একই সঙ্গে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে যাঁরা অপকর্মে জড়িয়েছেন, যাঁদের কর্মকাণ্ডে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁরাও প্রার্থী হতে পারবেন না।
বিএনপি সূত্র বলছে, দলের প্রভাবশালী নেতাদের পরিবারকেন্দ্রিক আসন বণ্টনের বিষয়েও এবার আগের চেয়ে কঠোর রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও আগামী সংসদ নির্বাচন ‘কঠিন হবে’ ধরে নিয়েই প্রার্থী বাছাইয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে যাঁরা এগিয়ে থাকবেন, তাঁরাই শেষ বিচারে দলের মনোনয়ন পাবেন।
এদিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারেও ভিন্নতা ও নতুনত্ব আনার পরিকল্পনা করেছে বিএনপি। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রচারের কৌশলে থাকবে নতুনত্ব। আধুনিক প্রযুক্তি এবং সনাতন পদ্ধতির সমন্বয়ে নির্বাচনী প্রচারে এবার বিশেষ কিছু থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচনের ঘোষণার পর বিএনপির নির্বাচনী কর্মযজ্ঞও দৃশ্যমান হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে, এমন ইঙ্গিত এরই মধ্যে অনেকেই পেয়েছেন। এই ইঙ্গিত পেয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাজও শুরু করেছেন। যদিও ইঙ্গিতই চূড়ান্ত নয় বলেও জানান বিএনপির এই নেতা।