এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কঠোর নিরাপত্তার কারাগার ছিল আলকাট্রাজ। আজও এ দ্বীপটি শাস্তি, বিচ্ছিন্নতা ও ন্যায়বিচারের নানা প্রশ্ন ঘিরে মানুষের কল্পনায় জীবন্ত।
সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরের মাঝখানে, ঠান্ডা পানি ও শীতল স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটি শিলা। নাম আলকাট্রাজ দ্বীপ।
বর্তমানে এটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান হলেও, ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কঠোর ও নিরাপদ ফেডারেল কারাগার।
এ কারাগার তৈরির পেছনে ছিল একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। যাদের অন্য কোথাও সামলানো যায় না, তাদের এখানে পাঠানো হতো। এখানেই ধরা পড়ে দেশের অপরাধ দমনের এক অন্ধকার ইতিহাস।
সেনাঘাঁটি থেকে কারাগার
আলকাট্রাজ প্রথমে ছিল একটি সামরিক দুর্গ। ১৮৫০-এর দশকে এটি তৈরি হয় উপসাগরের প্রবেশপথ রক্ষার জন্য। তারপরে এটি সামরিক কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে গৃহযুদ্ধের সময় বিদ্রোহীদের বন্দি রাখা হতো।
১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ বেড়ে যায়। সেই সময় সরকার একটি বিশেষ কারাগার খুঁজছিল, যেখানে সবচেয়ে বিপজ্জনক অপরাধীদের রাখা যাবে। আলকাট্রাজ দ্বীপের দূরবর্তী অবস্থান এবং প্রবল স্রোতের কারণে এটি উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।
কঠোর নিয়মের জগৎ
এই কারাগারে মোটামুটি ৩০০ বন্দি থাকতে পারতেন। তাদের সবাইকে আনা হতো অন্য কারাগার থেকে। যারা নিয়ম মানত না, পালানোর চেষ্টা করত কিংবা অত্যন্ত সহিংস ছিল- তাদের জন্যই মূলত ছিল এ কারাগার।
আলকাট্রাজের নিয়ম ছিল ভয়ানক কঠোর। দিনের বড় অংশে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। প্রতিটি সেলে ছিল শুধু একটি বিছানা, একটি টেবিল, একটি বেসিন ও একটি টয়লেট। খাবার, বিশ্রাম ও কাজ- সবই চলত নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়মে।

এই নির্জনতা ও নিয়মে বন্দিদের মনোবল ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। তবে অনেকেই এটিকে অমানবিক বলেই মনে করেন।
কুখ্যাত বন্দি ও পালানোর গল্প
আলকাট্রাজে অনেক কুখ্যাত অপরাধী বন্দি হিসেবে ছিলেন। যেমন:
# আল কাপোন, শিকাগোর কুখ্যাত গ্যাংস্টার, যিনি এখানে এসে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
# মেশিন গান কেলি, এক সময়ের বিপজ্জনক অপরাধী। তবে এখানে এসে শান্ত হয়ে যান।
# বার্ডম্যান, একজন অদ্ভুত ও মেধাবী বন্দি, যার জীবন নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা তৈরি হয়।
তবে এই কারাগারকে ঘিরে সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা হলো ১৯৬২ সালের পালানোর চেষ্টা। তিনজন বন্দি- ফ্রাঙ্ক মরিস ও অ্যাংলিন ভাইয়েরা- হাতে তৈরি সরঞ্জাম দিয়ে সেল ভেঙে বেরিয়ে যান এবং রেইনকোট দিয়ে তৈরি ভেলায় করে পানিতে নেমে পড়েন। তাদের আর খোঁজ মেলেনি। অনেকের মতে, তারা মারা গেছে, আবার কেউ কেউ মনে করেন, তারা পালাতে সফল হয়েছিল।
বন্ধ হয়ে যাওয়া ও নতুন পরিচয়
১৯৬৩ সালে কারাগারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে জানানো হয়, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশি ছিল এবং ভবনগুলোও জীর্ণ হয়ে পড়ছিল।
এর কয়েক বছর পর, ১৯৬৯ সালে কিছু আদিবাসী আমেরিকান অধিকার আদায়ের জন্য আলকাট্রাজ দখল করেন। তারা দাবি করেন, পরিত্যক্ত সরকারি জমি তাদের অধিকার।
এই আন্দোলন চলে ১৯ মাস এবং জাতীয়ভাবে আলোচনার জন্ম দেয়।
পরে, ১৯৭২ সালে আলকাট্রাজ যুক্ত হয় একটি জাতীয় ঐতিহ্যবাহী উদ্যানের অংশ হিসেবে। এরপর থেকে এটি ইতিহাস, শিক্ষা ও মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা ও চেতনার স্থান হয়ে ওঠে।
‘দ্য রক’-এর চিরন্তন প্রতীক
আলকাট্রাজ কারাগার খুব বেশি সময় চালু ছিল না। কিন্তু এর প্রভাব বিশাল। এটি শুধু এক কঠোর কারাগার ছিল না, ছিল একটি বার্তা- অপরাধ করলে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।

আজ আলকাট্রাজ একটি নিদর্শন, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিচ্ছিন্নতা, নিয়ন্ত্রণ ও ন্যায়বিচার নিয়ে আমাদের সমাজ কতটা পরিবর্তিত হয়েছে। এটি এক সময় মানুষের শরীর বন্দি করত, এখন মন ও চিন্তাকে নাড়া দেয়।
যতদিন মানুষ শাস্তি ও স্বাধীনতা নিয়ে ভাববে, ততদিন আলকাট্রাজ ইতিহাসের পাতায় অমর থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :