ঢাকা বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালাবে না মেটা

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম
ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালাবে না মেটা। ছবি - সংগৃহীত

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক প্রচারণা ও সামাজিক বার্তা প্রচারে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিশেষ করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে বিশ্বের নানা প্রান্তে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে থাকে। কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা এখন থেকে বদলে যাচ্ছে। জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠান মেটা ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিজ্ঞাপন আর চালাবে না।

এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ২০২৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম— উভয় প্ল্যাটফর্মেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে। গত ২৫ জুলাই মেটা কর্তৃপক্ষ এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

ইউরোপের নতুন নিয়ম কী?

মেটার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) আসন্ন “স্বচ্ছতা নীতিমালা” (Transparency Regulation)। এই নীতিমালা অনুসারে, ইউরোপের যেকোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চালানো রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে:

  • কার অর্থায়নে বিজ্ঞাপনটি চালানো হয়েছে
  • বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য কে বা কারা (Target Audience)
  • ব্যবহারকারীর কোন কোন ডেটা ব্যবহার করা হয়েছে
  • বিজ্ঞাপনটি কোন রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করছে

এই নতুন নিয়ম কার্যকর হলে মেটা ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানকে প্রতিটি বিজ্ঞাপনের বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। এতে প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর দায়িত্ব বেড়ে যাবে এবং প্রচারণার জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

মেটার সিদ্ধান্ত কেন?

মেটা মনে করছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন এই নীতিমালার কারণে তাদের জন্য রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিষ্ঠানটির ভাষায়, “এই নতুন নিয়মগুলো অত্যন্ত জটিল, অস্পষ্ট এবং তা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আইনি অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।” তাই মেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাজনৈতিক, সামাজিক ও নির্বাচনী বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেবে।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মেটা ইউরোপীয় আইনের জটিলতা এড়িয়ে চলতে চাইছে। তারা চায় না যে, কোনো ভুলের কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

নতুন নীতিমালার প্রভাব কী?

ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই স্বচ্ছতা নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য হলো

নির্বাচনী হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ: বিদেশি প্রভাব থেকে নির্বাচন রক্ষা করা।
তথ্য বিকৃতি ঠেকানো: মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো বন্ধ করা।
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: ভোটাররা যেন জানেন কোন রাজনৈতিক দল তাদের কাছে কী বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।

এই নীতিমালার ফলে ইউরোপে চালানো প্রতিটি বিজ্ঞাপন যেন পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হয়, সেটিই নিশ্চিত করতে চায় ইইউ।

ব্যবহারকারীদের জন্য এর প্রভাব

মেটার এই সিদ্ধান্তের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে:

  • আর কোনো রাজনৈতিক দল ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে বিজ্ঞাপন চালাতে পারবে না
  • নির্বাচনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে
  • সাধারণ ব্যবহারকারীরা হয়তো অনেক রাজনৈতিক তথ্য বা প্রচারণা পাবে না

তবে এতে করে ব্যবহারকারীরা ভুল তথ্য বা গোপনে চালানো প্রচারণা থেকে রক্ষা পেতে পারে, এমনটাই মনে করছে ইইউ।

কী ধরনের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হবে?

মেটা জানিয়েছে, যেসব বিজ্ঞাপন “রাজনৈতিক, সামাজিক বা নির্বাচনী বিষয়” এর সঙ্গে যুক্ত — কেবল সেগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হবে। যেমন:

  • নির্বাচনী প্রচারণা
  • রাজনৈতিক দলের বার্তা
  • সামাজিক আন্দোলন বা বিতর্কিত সামাজিক ইস্যু

তবে যেসব বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বা ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড প্রচারের জন্য, সেগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ

ইউরোপের অনেক রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন। কারণ:

  • সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে একটি প্রধান প্রচারমাধ্যম
  • অনেক দল বা প্রার্থী বিজ্ঞাপন চালিয়ে তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে চায়
  • বিশেষ করে ছোট দলগুলোর জন্য এটা এক ধাক্কা হয়ে এসেছে

তবে কেউ কেউ বলছে, মেটার এই পদক্ষেপে গোপন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বন্ধ হবে এবং আরও স্বচ্ছতা আসবে।

বিশ্বজুড়ে নজির স্থাপন?

মেটার এই সিদ্ধান্ত কেবল ইউরোপের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ যদি ইউরোপে এটি সফল হয়, তাহলে হয়তো অন্য দেশগুলোতেও একই ধরনের স্বচ্ছতা নীতিমালা চালু হতে পারে।

অনেক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, “ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।” অন্যদিকে, বাকস্বাধীনতা ও নির্বাচনী প্রচারের অধিকারের প্রশ্নও উঠছে।

মেটা’র ব্যবসার উপর প্রভাব

রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন মেটার মোট আয়ের খুব বড় অংশ না হলেও নির্বাচনের সময় এই খাত থেকে তাদের উল্লেখযোগ্য আয় হয়। ইউরোপে এই বিজ্ঞাপন বন্ধ হওয়ায়:

  • ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে বিজ্ঞাপন রাজস্ব কিছুটা কমতে পারে
  • ইউরোপের বাজারে মেটার প্রভাব কিছুটা কমতে পারে
  • অন্য মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে

ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার প্রশ্ন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন অনুযায়ী, ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Data) ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালানো সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। ব্যবহারকারীদের জানাতে হবে, কেন তাদের সেই বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে।

এই অংশটি নিয়েও মেটার আপত্তি রয়েছে। কারণ এতে ব্যবহারকারীর ডেটা ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়ে।

মেটার এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন ইউরোপে সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্রচারণার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনকে নিয়ন্ত্রণ করা কি তথ্যের প্রবাহ রোধ করবে, না কি তা তথ্য সুরক্ষা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে — এই বিতর্ক এখনও চলছে।

ইউরোপের মতো শক্তিশালী অঞ্চলে এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে অন্যান্য দেশগুলোও হয়তো নিজেদের নীতিমালা ঢেলে সাজাতে আগ্রহী হবে। প্রযুক্তি এবং গণতন্ত্রের এই সম্পর্ক আগামী দিনে আরও গভীর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।

সোর্স: মেটা অফিশিয়াল প্রেস রিলিজ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট নীতিমালা, বিবিসি ফিউচার