ঢাকা শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫

নারী শিক্ষার্থীদের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখিনি: মুহিব্বুল্লাহ

বাসস
প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৫, ১০:৫১ এএম
মুহিব্বুল্লাহ মুহিব। ছবি- বাসস

কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু। যার সমাপ্তি ঘটে এক দফার স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে। জন্ম নেয় এক নতুন বাংলাদেশ। জুলাই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এ দেশের আপামর ছাত্র-জনতা। 

সেই গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। তার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েও। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সেই সময় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনায় যারা সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মুহিব্বুল্লাহ মুহিব অন্যতম। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার হাশেম আলী মীরের সন্তান মুহিব্বুল্লাহ মুহিব। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খানজাহান আলী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগরের যুগ্ম সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। 

সম্প্রতি তিনি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

বাসস: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। জুলাইয়ের সেই সংগ্রামী সময়ের স্মৃতি এখনো অনুভব করতে পারেন কি?

মুহিব্বুল্লাহ: এখনো তো সেই স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে, মানে ওই সময়গুলোতে ছিল আশা, হতাশা ও ভয়- এই তিন বিষয়ের মিশ্রণ। কী করব, কী না করব- এই দোলাচলের পাশাপাশি সহযোগিতা করার লোকেরও অভাব ছিল। অল্প কিছু মানুষ যারা শেল্টার দিচ্ছিল তারাও বলেছে যে খুলনা থেকে চলে যাও। 

সেই ভয়ের সময়গুলোতে নিজেরা শক্ত অবস্থানে ছিলাম এবং যখন শুনতাম যে এখানে পুলিশ আসছে, সেখান থেকে অবস্থান পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় চলে যেতাম। কীভাবে রিকশা নিয়েছি, লুকিয়ে থেকেছি এসব এখন চোখে ভাসে। আবার মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে শুনতে পাই ‘কোটা, না মেধা’ এই স্লোগান, কানে বাজে এখনো। আবার যে জিরো পয়েন্ট থেকে মিছিল নিয়ে আসতেছি, সেখানে পুলিশের হামলা, লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও গুলি- এটাও চোখে ভাসে। 

এ ছাড়া আর একটি বিষয়, আগস্টের দুই তারিখে খুলনায় পুলিশের সঙ্গে যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছিল, ওই ভয়াবহতা এখনো চোখে ভাসে। আমরা তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছি- আমরা তো মোটামুটি সিনিয়র, আমাদের ভয়-টয় একটু কম। কিন্তু যারা সাধারণ শিক্ষার্থী নাইন, টেন-এই লেভেলের শিক্ষার্থীরাও ছিল আমাদের সঙ্গে। তারা এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। তো তারা বাসায় যাবে কীভাবে, কী করবে- তারা তো আমাদের মুখ দেখে, আমাদের ভরসায় আসছে। 

তো তাদের সেই আতঙ্কিত মুখটাও এখন ভাসে। তাদের আকুতি ছিল যে ভাই আমরা এখন কীভাবে বাসায় যাব? ওই সময় আমরা তাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে বাসায় বাসায় পৌঁছে দিয়েছি। সেই ভয় আর আতঙ্কের সময়গুলো এখনো চোখে ভাসে। আন্দোলনের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে, তবু মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। জিরো পয়েন্টে এখনো টিয়ারশেলের ধোঁয়া উড়ছে।

বাসস: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন, সে আন্দোলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ভূমিকা রাখে। তখন আমরা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। ওই আন্দোলনের পরও কোটা বহাল রাখা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আবারও আন্দোলন শুরুর চিন্তা করি। 

এই কোটাটা এত পরিমাণ ছিল- দেখা যাচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধা, পোষ্য ও নারীসহ অন্যান্য কোটায় ৯০ শতাংশের চাকরি হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে আমাদের দেশে মেধায় কোনো চাকরি পাওয়া যাচ্ছিল না। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুই পার্সেন্ট জনগণ শুধু কোটার বাইরে ছিল। অন্য ৯৮ পার্সেন্ট কোটায় চাকরি হচ্ছে। নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর জন্য অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা এবং আর একটি গোষ্ঠী একদম অবহেলিত ছিল। প্রকৃত মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছিল না। যার প্রেক্ষিতে কোটা আন্দোলন শুরু হয়। একটি দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

বাসস: আপনারা কি শুরুতেই জানতেন যে কোটা সংস্কার আন্দোলন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে?

মুহিব্বুল্লাহ: না, আমরা আসলে শুরুতে এটা ভাবিনি যে এরকম আন্দোলন হবে এবং আমরা এরকমও ভাবিনি, মানে ফ্যাসিস্ট রেজিম এমনভাবে ভর করেছিল যেকোনোভাবে এর পতন হবে। কিন্তু তবু সবসময় মনের মধ্যে একটা আশা ছিল, কিছু হোক বা রেজিমটা চলে যাক- এরকম ভাবতাম। কিন্তু সমাধানের পথ ছিল না। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের একপর্যায়ে এসে মনে হয়েছে যে এই আন্দোলন দিয়েই তাকে আমরা হিট করতে পারি।

বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: আন্দোলনের প্রথম দিকে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একসময় ১৭ জুলাই আমাদের হল ভ্যাকেন্ট করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার আগ পর্যন্ত বলা যায় একচ্ছত্র ভাবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েই এই আন্দোলনটা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে আসতো। কিন্তু যখন হল ভ্যাকেন্ট হয় তখন তো দূরের শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যায়। 

অভিভাবকরা বার বার কল দিয়ে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। বলে, এখানে এসে আন্দোলন করো। তখন শিক্ষার্থীরা এলাকায় গিয়ে অনেকেই আন্দোলন করে। এর মধ্যেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলনের স্বার্থে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কেউ কেউ সিনিয়রদের বাসায়, আবার কেউ টিউশনি করত- সেই স্টুডেন্টদের বাসায়, আবার অনেকেই মেসে থেকে আন্দোলনে অংশ নিত। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিল। 

এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা যেখানে থাকত সেখানে প্রতিদিনই পুলিশ গিয়ে নানাভাবে হয়রানি করতো। এত হয়রানি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনোদিনই হয়নি। আমাদের হল রোডে কখনো পুলিশ ঢুকত না৷ কিন্তু আন্দোলনের সময় পুলিশ যেত। যে কারণে শিক্ষার্থীরা চা খেতে পারত না। ওই সময় পুলিশ হোটেল ও খাবারের দোকানগুলোও বন্ধ করে দেয়। যাতে শিক্ষার্থীরা খেতে না পারে। এমনকি লুঙ্গি পরে চা খেতে বের হলেও পুলিশ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ এবং চরম দুর্ব্যবহার করত। ওই জন্য শিক্ষার্থীরা চলে যেতে বাধ্য হয়। তারপরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে গেছে।

বাসস: ক্যাম্পাসের অহিংস কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিল কীভাবে?

মুহিব্বুল্লাহ: সহিংস হয়েছে মূলত ছাত্রলীগের কারণে। মানে তারা নিরাপত্তার জন্য হাতে লাঠি বা রড-এগুলো নিয়েছে। কারণ আমরা যখন আন্দোলন করতাম, রাতের বেলায় বাসায় আসতাম, তখন দেখতাম ফেসবুকে নানা রকম ম্যাসেজ। যে, আজকে ওমুক নেতার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ আসবে- আক্রমণ করবে ওই গলিতে, ওখান থেকে আক্রমণ করবে- সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে শ্রমিক বাহিনী বের হবে- এরকম নানান কথা শুনতাম। 

তখন আমাদের ভার্সিটি থেকে মিছিল নিয়ে তো বের হতে হবে- সে শিববাড়ি যাই আর জিরো পয়েন্ট যাই বা সাচিবুনিয়ায় যাই। যেখানেই যাই না কেন, মিছিল নিয়ে তো যেতে হবে। ওই সময় আমাদের তো রিস্ক হয়ে যায়। এটলিষ্ট আমাদের ওপর আক্রমণ হলে আমরা যাতে প্রতিহত করতে পারি, সে জন্য আমাদের হাতে বাঁশের লাঠি, গাছের কাঠ, জিআই পাইপ-এই টাইপের দেশি অস্ত্র রাখি, শুধু নিরাপত্তার জন্য, কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। আঘাত আসলে যেন প্রতিহত করতে পারি।

বাসস: আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: খুলনায় আমাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সরাসরি কোনো সংঘর্ষ হয়নি। কারণ যখনই শুনেছি যে এই রুট দিয়ে ছাত্রলীগ আসছে, তখনই আমরা কৌশল অবলম্বন করে অন্য রুটে গিয়েছি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েক জায়গায় হালকা-পাতলা সংঘর্ষ হয়েছে। 

এর মধ্যে ২ আগস্ট নিউ মার্কেট থেকে আমাদের মিছিল হওয়ার কথা ছিল। ওইদিন জুমার নামাজ পড়ে বাইতুন নূর মসজিদ থেকে আমরা যেই বের হয়েছি। তখনই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে। আর আগস্টের ৪ তারিখে আওয়ামীলীগ নেতা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম অস্ত্র নিয়ে বের হয়। 

এ ধরনের কয়েকটি ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং তাদের মধ্যে ভয়ের পরিবর্তে সাহস বেড়ে যায়। যে, আমরা তো একা একা থাকলে মার খাব, তো আমরা সবাই সংঘবদ্ধ থাকব। যেখানেই যাবো আমরা একসঙ্গে যাব। এভাবেই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেউ আন্দোলন থেকে সরে যায়নি।

বাসস: আন্দোলনের নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ মোটামুটি ভালো ছিল। প্রথম দিক থেকেই তারা একদম সামনের সারিতে ছিল। নারী শিক্ষার্থীরা সবসময় ব্যানার ধরত এবং তাদের যে সাহস, মাঝে মাঝে কিছুদিন তো আমাদের নিজেদের মনেও ভয় কাজ করত, কিন্তু তাদের মুখে কোনো ভয়ের ছাপ আমরা পাইনি। 

হয়তো ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে অনেকে আসতে পারেনি। কিন্তু যারা যখন যেভাবে আসছে কখনো পিছপা হয়নি এবং তারা ওইখানে বসে পড়েছে। কিন্তু তারা পিছিয়ে যায়নি। তারা অনেক সাহসী ভূমিকা রেখেছে। আমরা তাদের প্রোটেকশন দিতাম। অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে আমরা চতুর্দিকে থাকতাম, আর নারী শিক্ষার্থীরা ভেতরের দিকে থাকত। আমরা কখনো তাদের ছেড়ে যাইনি। প্রথম দিকে একশ-দুইশ থাকলেও শেষের দিকে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায়। প্রতিদিনই তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

বাসস: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুথান-স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কীভাবে চলমান ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বলতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন মানে সরকার নিজেই আসলে তাদের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছে। কারণ একের পর এক যত বেশি দমন পীড়ন করেছে, আন্দোলন ততবেশি ফুঁসে উঠেছে। যত বেশি দমন-পীড়ন চালিয়েছে, ততবেশি তাদের ওপর সেটি ব্লাস্ট হয়ে পড়েছে। 

সবচেয়ে বেশি ইমপ্যাক্ট আমার কাছে মনে হয় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা কারণে হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপরও ছাত্রলীগ যখন নিপীড়ন চালাতে শুরু করল তখন আন্দোলনের গতিই পাল্টে গেল। ওবায়দুল কাদের তো নিজেই বলল, ‘এই আন্দোলন দমানোর জন্যে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। 

তারপর থেকে ছাত্রলীগ আক্রমণ করা শুরু করে। এরপর থেকেই শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষুব্ধ হয়। যে, কীসের এত সমস্যা। এটা তো যৌক্তিক দাবি, মারবে কেন এটার জন্য। এ জন্য তারা আরও বেশি ডিটারমাইন্ড হয়ে যায়। সরকার যত বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে এবং বিরোধী আচরণ করেছে- শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণও তত ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। 

আন্দোলনে প্রথমে তো শুধু শিক্ষার্থীরা আসত, তারপর জনগণও আসতে শুরু করে এবং অভিভাবকরা ভাবে যে, আমার ছেলে তো অনিরাপদ, মারা যাচ্ছে- সুতরাং আমরাও যাব। আমাদের ছেলেদের মারলে আমরা কেন ঘরে বসে থাকব। এ সময়ে রিকশাওয়ালা ও ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সমাজের নিচু শ্রেণি থেকে এলিট শ্রেণি সবাই তখন আন্দোলনে আসতে শুরু করে।

খুলনায় প্রথম আন্দোলন শুরু হয় ৬ জুন। খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে থেকে, বর্তমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা জেলার সদস্যসচিব সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি ডেকেছিল। এর আগে আমরাও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা শুরু করি। পরীক্ষার পর ওই সময় ভার্সিটি বন্ধ থাকায় আমাদের ছেলে-পেলেরা আসতে পারেনি। 

তবে পরে ৭ জুন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রথম কোটা সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন করি। তারপর আবার ঈদের ছুটি শুরু হয়। ছুটির পর ২৪ জুন আমরা সবাই বাসা থেকে আসি। ৪ জুলাই আবার আমাদের আন্দোলন শুরু হয়- এভাবে কর্মসূচি বাড়তে থাকে। একেক দিন পথসভা বা বিক্ষোভ মিছিল বা মশাল মিছিল করা হয়। 

কর্মসূচিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, জিরো পয়েন্ট ও সাচিবুনিয়া কেন্দ্রিক ছিল। তারপর ৬ জুলাই শিববাড়ি মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এভাবে প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, পথসভা, মশাল মিছিল, ব্লকেড- এভাবে কর্মসূচি পরিবর্তন করে করে নতুন ডাইমেনশন আনার চেষ্টা করি। পাশাপাশি আন্দোলনের প্লেস পরিবর্তন করা হতো। যাতে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং অংশগ্রহণ থাকে। এভাবে সব এলাকার লোকজনের সম্পৃক্ততা বাড়ে।

আবার প্রশাসনের দমন-পীড়নের কারণেও আমরা স্থান পরিবর্তন করতাম। এভাবে ৯ জুলাই সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, ১০ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। যখন ছাত্রলীগ এবং পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয় সেদিন থেকে আমাদের ধীরে ধীরে ছাত্রলীগবিরোধী অবস্থান তৈরি হয়। 

খুলনায় ৩০ জুলাইয়ের পূর্ববর্তী সময়ে থ্রেট দিলেও ৩০ জুলাই শিববাড়ি মোড়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশ হামলা করে। আমার বন্ধু আহাদকে চড় মারে এবং কয়েকজনকে ধাক্কা দেয়। যাতে তারা চলে যায়- এরকম একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে তারা। ওইদিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই আমাদের পুলিশ ফোন করে সার্কিট হাউসে ডেকে নিয়ে যায়। 

সেখানে আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন ছিলাম। এ ছাড়া আরও কমার্স কলেজের রাফসান এবং ইমন নামে নর্থ ওয়েস্টার্নের একজনসহ আরও ৫-৬ জন শিক্ষার্থী ছিল। কেএমপির নারী পুলিশ কর্মকর্তা রাশিদা বেগম এবং সিটিএসবির বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কর্মরত কবির নামে একজন তাদের জানায় যে আলোচনার জন্য তোমাদের ডাকা হয়েছে। 

আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলবে এবং আমাদের দাবি তারা শুনবে। কিন্তু আমরা জানাই, আমরা যেতে পারব না, এটা সম্ভব না। তখন তারা পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের জানায়, ওরা আসবে না। তখন তারাই আমাদের সরাসরি ফোন করে যেতে চাপ সৃষ্টি করে। অলরেডি তখন নাহিদ ইসলামসহ আমাদের কেন্দ্রীয় ৫ জন সমন্বয়ক ডিবি হারুনের কাছে বন্দী। 

ওইজন্য আমরা আসলে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম যে আমাদের নিয়েও তো এরকম আটক করতে পারে। কিন্তু পুলিশ জোর দিয়ে বলে, ‘আপনাদের আসতেই হবে’। তখন আমরা আমাদের ব্যাচমেট ও সিনিয়র বন্ধুদের ডেকে বসে করণীয় নিয়ে আলোচনা করি। আমরা চিন্তা করলাম, যদি না যাই-দেখা গেল আমাদের ধরে নিয়ে গেল। তখন আমরা দুটি শর্ত ঠিক করি। হয়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের দপ্তরে বসব অথবা আমাদের স্যারেরা আমাদের সঙ্গে যাবে। 

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বসার বিষয়ে পুলিশ অফিসার রাশিদা বেগম রাজি হলেন না। তবে আমাদের সঙ্গে স্যারদের যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিলেন। কিন্তু তখনও তিনি আমাদের বলেননি যে আওয়ামীলীগ নেতারা সেখানে থাকবে। পরবর্তী সময়ে রাত ১০টার দিকে আমাদের সব ধরনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেতে বলে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহকারী ছাত্রবিষয়ক পরিচালক রাজু রায়, রকিবুল ইসলাম টুটুল এবং সৌরভ চক্রবর্তী- এই তিনজন স্যার আমাদের সঙ্গে যায়। 

সেখানে আমার সঙ্গে ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল তানভীর, আয়মান আহাদ, বিপুল শাহরিয়ার, আজিম ইসলাম জিম, সিয়াম ও কাজী ফাহাদুল ইসলাম। আমরা গেলাম সেখানে, যাওয়ার পর দেখি পুলিশের কয়েকটি প্রিজন ভ্যান সার্কিট হাউজের বাইরে রাখা এবং আশেপাশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছে। 

তখন আমরা বুঝতে পারলাম পরিবেশ মনে হয় একটু অন্য রকম। তখন ভেতরে গিয়ে দেখলাম আরও অবস্থা খারাপ। ওইদিন সার্কিট হাউসে খুলনার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন সবাই ছিল। একই সঙ্গে তৎকালীন কেসিসির মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, খুলনা-৩ আসনের এমপি এস এম কামাল এবং যুবলীগের শফিকুর রহমান পলাশ ও শেখ শাহজালাল সুজনসহ আওয়ামীলীগ-যুবলীগের অনেক নেতা ছিল। 

কিন্তু আমরা তো ভাবিনি আওয়ামী লীগ নেতারা থাকবে। আমরা ঢোকার পর আমাদের কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে তারাই প্রথমে কথা বলা শুরু করল। মানে, তারা এরকম থিম দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে যে এই আন্দোলনটা জামায়াত-শিবিরের আন্দোলন, এটা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন না, তোমাদের মাথার ওপর কাঁঠাল ভাঙছে-এরকম নানান কিছু। এমনকি বলে, এটা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। এসব বলে তারা সেখানে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করল যে সেখানে আর কথা বলার সুযোগও ছিল না। 

মানে, এমনভাবে তারা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে এটা হলো সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, তোমরা এই ষড়যন্ত্র করতে পার না। ওখানে আর কিছুই বলার ছিল না এমন একটা অবস্থা। তারপরও ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু হলো। ২/৪ জন কথা বলার পর আমার পালা আসার আগেই রাফসান ঢুকেছে সেখানে। রাফসান ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তালুকদার আবদুল খালেক তার কাছে জিজ্ঞাসা করে তুমি কে, এই আন্দোলন সম্পর্কে কি জানো? এভাবে প্রশ্ন করে আন্ডারএস্টিমেট করার চেষ্টা করে। মানেটা এমন যে তোমরা জানো না কিছুই, সব তো সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র। সে বলল, হ্যাঁ এই আন্দোলন সম্পর্কে তো জানি। 

তখন বলে তোমাদের দাবি কি এখন? তোমাদের দাবি তো সরকার মেনে নিয়েছে। তখন রাফসান বলে যে আমাদের দাবি তো ৯ দফা। তারা বলে ৯ দফা কি বলতে পারবা? সে বলে, হ্যাঁ বলতে পারব। তখন ৯ দফার প্রথম দফা ‘শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে গালি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে’। 

যখনই সে বলে যে ক্ষমা চাইতে হবে, তখনই তালুকদার আবদুল খালেক এবং এস এম কামাল টেবিলের ওপর থাবা দিয়ে ইচ্ছামতো মা-বাবা ও পরিবার তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে এবং বলে তোদের এতবড় সাহস? প্রধানমন্ত্রী তোদের কাছে ক্ষমা চাইবে, কী হইছিস তোরা? কাল আন্দোলনে আসিস শিববাড়ির মোড়ে, তোদের দেখে নেব, দেখি তোদের কতবড় সাহস। 

এরকম নানান হুমকি-ধামকি দিতে শুরু করে। এ সময়ে আলোচনা বা কথা বলার আর কোন সুযোগ ছিল না। রাফসানের ওপর তারা যেন আক্রমণ না করে এজন্য আমরা তাকে সেইফ করার চেষ্টা করি। তখন তারা বলে যে এখনই ঘোষণা দিয়ে তোমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে। ওই সময়ে কেউ আমাদের পক্ষে ছিল না। তখন তারা আমাদের বুঝায় যে, এটা জামাত-শিবিরের আন্দোলন, তোমরা এখান থেকে সরে আসো, তোমাদের লাইফ হুমকি, চাকরি পাবা না। 

আর সরকারের কিছুই হবে না, তোমাদের লাইফে বড় ক্ষতি হবে- ইত্যাদি। সেখানে আমাদের স্যাররা আমাদের জন্য কোনো ভূমিকা রাখেনি, তারা কেউ আমাদের সেইফ করেনি, সবাই চুপচাপ ছিল। কিন্তু তাদের ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। একপর্যায়ে রাত একটার দিকে সেখানে সাংবাদিকদের ডেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করে। 

ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে আমাদের বের হতে দেয় না। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওখান থেকে বের হওয়ার কৌশল হিসেবে কোনোমতে খুলনার আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেই। কিন্তু একটি শর্ত দিই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হল রোড থেকে পুলিশ সরিয়ে নিতে হবে। তবে সার্কিট হাউজ থেকে বের হয়ে আসার পথে গাড়িতে বসেই আমি নিজেই ফেসবুক এবং আমাদের গ্রুপে ‘আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা’ প্রত্যাহার করা হলো বলে বিবৃতি দিই। 

সেখান থেকে আমরা ফিরে এসে সবাই প্রচুর কান্নাকাটি করতে থাকি। যে, আমরা তো কোনো অযৌক্তিক কিছু করিনি, একটি যৌক্তিক আন্দোলন করছি। তখন তো অনেক লাশ পড়ে গেছে। ভাইয়ের রক্তের ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করায় আমাদের কান্না আসছিল। কারণ ১৭ জুলাই হল বন্ধ হওয়ার পরেও ৩০ তারিখ পর্যন্ত আমরা তীব্র আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। যার সবটাই তো বৃথা হয়ে গেল।

পরদিন ৩১ জুলাই বেলা ১২টার দিকে নগরীর সাতরাস্তা মোড়ে অবরোধ কর্মসূচিতে হামলা করে পুলিশ। সেখানে আমাদের শাহরিয়ার ভাই এবং মিরাজকে প্রচুর মারধর করে। সেখান থেকে বিভিন্ন থানায় আমাদের ৮৩ জন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। সেখানে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মোজাম্মেল হক ও এস আই সুকান্তসহ অনেক পুলিশ সদস্য লাঠিচার্জ ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। 

এমনকি নারী শিক্ষার্থীদেরও পুরুষ পুলিশ সদস্যরা টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। যদিও গভীর রাত পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রতিটি থানায় গিয়ে ‘শিক্ষার্থীরা আর আন্দোলনে আসবে না’ এরকম মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। পরদিন ১ আগস্ট আন্দোলন একটু ঢিলে হয়ে যায়। তবে, সেদিন আমরা বসে আন্দোলন কীভাবে আরও জোরদার করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা করি। 

সেখানে জামাত-শিবির এবং বিএনপি আমাদের প্রচুর সাপোর্ট দেয়। এমনকি তারা দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়। শুক্রবার (২ আগস্ট) আবারও শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে মিছিল বড় হতে থাকে। জুমার নামাজ শেষে নিউ মার্কেট থেকে গুটি কয়েক লোক নিয়ে শুরু হওয়া মিছিল শিববাড়ি আসতেই ৫শ থেকে ১ হাজার লোক পার হয়ে যায়। 

মিছিলটি সোনাডাঙ্গা আসতে আসতেই ২ হাজার লোক পার হয়ে যায়। মানে একটি করে মোড় পার হচ্ছে- আর ৫শ-১ হাজার করে লোক কোথা থেকে যে জড়ো হচ্ছে- তা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। তখন আর আন্দোলন ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্য পেশার লোক, অভিভাবকসহ প্রকৃত ছাত্র-জনতার মিছিলে রূপ নেয়। মিছিলে প্রায় ২০ হাজার লোক হয়ে যায়। 

মিছিলটি সোনাডাঙা থানার সামনে গেলে পুলিশের সঙ্গে হালকা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। তবে, পুলিশ আশ্বস্ত করে তোমাদের ওপর কোনো আক্রমণ হবে না। কিন্তু মিছিলটি গল্লামারি ব্রিজ পার হওয়ার পর  পুলিশের আক্রমণ শুরু হয়। তখন তারা টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট ও লাঠিচার্জ করে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে ‘শেকল ভাঙার গান’ নামে আরও একটি কর্মসূচি চলছিল। 

উদ্দেশ্য ছিল, গল্লামারি থেকে যাওয়া মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে এক সঙ্গে জিরো পয়েন্টের দিকে যাবে। কিন্তু পুলিশ আক্রমণ করায় ছাত্র-জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সেখানে শতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হয়। তখন সবাই আরও ক্ষিপ্ত হয়ে হরিণটানা থানার দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় খুলনা বাইপাস সড়ক থেকে আরও পুলিশ এসে মুহুর্মুহু টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তখন খবর শোনা যায়, আমাদের দুজন শিক্ষার্থীকে থানায় আটক রাখা হয়েছে। পরে সেখানে একটি মিছিল নিয়ে আমাদের দুইজন প্রতিনিধি হেলাল ভাই ও মিনহাজ ভাই থানায় গিয়ে দেখতে পায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, টিয়ারশেল ও ছররা গুলি কারো চোখে, কারো হাতে-পায়ে লেগে আহত হয়েছে। সাফিন নামে একজন চোখে গুলিবিদ্ধ হয়। 

পুলিশ আবারও প্রতিশ্রুতি দেয়, আপনাদের কিছুই বলা হবে না। তখন আমরা মিছিল নিয়ে গল্লামারি ফেরার পথে ব্রিজে উঠলে আবারও পুলিশ হামলা শুরু করে। সেখানে শত শত পুলিশ উপস্থিত হয়ে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ করে। সেখানে শিক্ষার্থীরাও তাদের ওপর ইট-পাটকেল ছুড়ছিল। কিন্তু তখন টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় টেকা যাচ্ছিল না। এভাবে একবার শিক্ষার্থীরা আগায়, একবার পুলিশ আগায়- দীর্ঘ সময় সংঘর্ষ চলে। 

এদিকে আহতদের আমরা ভার্সিটির মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে চিকিৎসা দিই। আর গুরুতর আহতদের ৭-৮টি অ্যাম্বুলেন্স করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাই। ৩ আগস্ট খুলনায় কোনো আন্দোলন ছিল না। ৪ আগস্ট আবার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়। ওইদিন আমরা সকাল ১০টায় শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হই। সেখানে প্রচুর পরিমাণ ছাত্র-জনতা যোগ দেয়। ওইদিন আমাদের কাছে খবর আসে- ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সোনাডাঙা থেকে শ্রমিকলীগ আমাদের ওপর আক্রমণ করবে। 

এ কারণে আমরা নিরাপত্তার জন্য হাতে লাঠি এবং রড রাখি। তারপর বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ আরও বাড়তে থাকে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার লোকের সমাগম হয়। আন্দোলন চলতে চলতে এমন সময় একটি খবর আসে শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। তখন সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ে। হাতে থাকা পানির বোতল এবং খাবারের প্যাকেট ছুড়ে উল্লাস করতে করতে একটি অংশ মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে চলে যায়। 

তার মধ্যেই খবর আসে, আওয়ামী লীগ অফিসে অ্যাডভোকেট সাইফুলসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। এক পর্যায়ে অ্যাডভোকেট সাইফুল অস্ত্র নিয়ে বের হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার মিছিল দেখে তারা পিছু হটে। ওই সময় আওয়ামী লীগ অফিস, শেখ বাড়ি ও প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। তবে তার কিছুক্ষণ পরে শোনা যায় হাসিনার পতন হয়নি। 

আবার ওইদিনই ঢাকার সমন্বয়করা ঘোষণা দেয় হাসিনা পতনের একদফা দাবিতে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ৬ তারিখের পরিবর্তে ৫ তারিখে হবে। তখন আমাদের মনে আশা তৈরি হয়  আগামীকালকেই শেখ হাসিনার শেষ দিন। তখন আমরা চিন্তা করলাম যে ঢাকায় যাবো। কিন্তু ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ হচ্ছে। এ কারণে রিস্কি হয়ে যায়। আমরা তাই খুলনাতেই আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিই। এভাবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার খবরে খুলনার সাধারণ জনতা রাজপথে বের হয়ে বিজয় উদযাপন করে।  ৬ আগস্ট খুলনায় বিজয় মিছিল হয়।

বাসস: আন্দোলনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের ভূমিকা কী ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: সাংবাদিকরা সবসময় আন্দোলনের পক্ষে ছিল। আমি নিজেও চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। সে সময় বিপক্ষে কেউ ছিল না, সাংবাদিকরা সবাই শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিল।

বাসস: আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা তো সবসময় নেগেটিভ ছিল। তারা সরকারি একটা বাহিনী ছিল। তারা জনগণের জন্য ছিল না, তারা সরকারের নিরাপত্তার জন্য ছিল। পুলিশ প্রশাসন সব সময় আমাদের ব্যাপক হুমকি-ধামকি দিয়েছে। প্রত্যেকটা দিন থানার ওসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁড়ির পুলিশ আমাদেরকে বলত, এ আন্দোলন তো কিছুই না, এতে কিছুই হবে না। তবে সবাইকে একসঙ্গে না ব্যক্তিগতভাবে বলত। 

পুলিশ এও বলত, হাসিনা সরকারকে চেনো তোমরা? তোমাদের একসাথে ৪-৫ হাজার মানুষকে মেরে দিলে আন্দোলন ঠান্ডা হয়ে যাবে। তার চেয়ে তোমরা এ আন্দোলন না করে পড়াশোনা করো, চাকরি পাবা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারভাগ শিক্ষকের মধ্যে তিন ভাগ আমাদের পক্ষে ছিল। অন্যরা সরকারের পা চাটা হয়ে গিয়েছিল। তারা তো হল বন্ধ করে দিয়েছিল। যদিও মুখে মিষ্টি কথা বলত। কিন্তু হল বন্ধ করা মানে কি, মানে তো আন্দোলন দমে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবশ্যই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল।

বাসস: আন্দোলন চলাকালে ব্যক্তিগত কী ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন?

মুহিব্বুল্লাহ: আমি তো এই ক্যাম্পাসে আগে থেকেই হুমকিতে ছিলাম। কারণ আমার বাবা জামায়াতে ইসলামী এবং আমার চাচা বিএনপির রাজনীতি করেন। এ কারণে সবসময় হুমকিতে থাকতাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলত তোমার পারিবারিক বিষয় আমরা জানি এবং থানা থেকে ওসি প্রায়ই ডেকে নিয়ে ভয় দেখাত। এমনকি তুলে নিয়ে অস্ত্র মামলায় বা হাতে গাঁজা-মদ দিয়ে কোর্টে চালান দেওয়ারও হুমকি দিত। এভাবে অনেককে পারিবারিকভাবে চাপও দেওয়া হতো।

বাসস: আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চার ভাগের তিন ভাগ ছিল আন্দোলনের পক্ষে। তারা সবসময় আমাদের পক্ষে ফেসবুকে লেখালেখি করত। অনেক স্যার আমাদের টাকা-পয়সা দিয়েও সহযোগিতা করেছে। একটা আন্দোলন করতে অনেক টাকা খরচ হত। নরমালি মাইক ভাড়া লাগত প্রতিদিন ১৫শ টাকা। 

ব্যানার এবং ছেলে-পেলেদের নাস্তা-পানি করতে প্রতিদিন প্রায় তিন-চার হাজার টাকা খরচ হত। ১০-১২ জন শিক্ষক আমাদের আর্থিক সহায়তা করত। অন্যরা আমাদের পক্ষে ফেসবুকে লেখালেখি করত এবং আমাদের সাহস যোগাত। শিক্ষকরা বলতেন, কোনো সমস্যা নেই, আমরা আছি। কোথাও সমস্যা হলে আমাদের জানিও, আমাদের বাসায় এসে থেকো- এরকম অনেক শিক্ষক বলেছে। মুগ্ধ হত্যার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে আমাদের মানববন্ধনে দু’শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন। সেখানে তারা সরাসরি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ান।

বাসস: বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন ছিল?

মুহিব্বুল্লাহ: আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা এখানে দুই গ্রুপ। একটা হলো- আন্দোলনের একটু কম বিপক্ষে। আর একটা হলো- একটু বেশি বিপক্ষে। তবে এর মধ্যে আর একটা গ্রুপ ছিল- তারা এক দফার বিপক্ষে ছিল। যখন আন্দোলন এক দফায় চলে গেছে তখন তারা বলে, এতদিন পক্ষে ছিলাম, কিন্তু এখন এক দফার পক্ষে না। তারা আরও বলতেন, শিক্ষার্থীরা মনে হয় ভুল বুঝতেছে, একটু বিষয়গুলো ভাবা দরকার। এরকম লিবারেল টাইপের অনেক কথা অনেক শিক্ষকের মুখে শুনেছি। এমনকি তারা ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার দিয়েও এক দফার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিশেষ করে যারা প্রশাসনে ছিল তারাই এ কাজ করেছে। কারণ প্রশাসনে আওয়ামীপন্থিরাই ছিল।

বাসস: আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের জন্য আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

মুহিব্বুল্লাহ: আমরা সব সময় শহীদ পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি আপনার সন্তান মারা গেছে, আমরাই আপনার সন্তান। আপনার সন্তান কেন গেছে, রক্ত দিয়েছে দেশের ভালোর জন্য, আপনার সন্তান শহীদ, আপনি একজন শহীদের বাবা-মা, আপনি এটা ভেবে নিজেকে গর্বিত মনে করবেন। 

এরপর আমরা পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছি, যতটুকু পেরেছি তাদের আর্থিক সহযোগিতার চেষ্টা করেছি বা যেখানে যেখানে সরকার বিভিন্ন সময় তালিকা চেয়েছে সেই তালিকায় নাম উঠাতে সহযোগিতা করেছি। আমাদেরতো নিজের টাকা নেই, টাকা দিয়ে হেল্প করতে পারবো না। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা থেকে যখন প্রণোদনা বা ভাতা বা অনুদান দেওয়া হয়েছে আমরা তাদের নামও সেখানে দিয়েছি। তাদের পরিবার যাতে ভালো থাকে সেই চেষ্টা করেছি। 

তাদের ছেলেকে তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না, আবার আমাদের টাকাও নেই। তবে যতদূর করা যায়, প্রচেষ্টা আমরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাদের তালিকা করেছি, ঈদে তাদের বাসায় গিয়েছি, খোঁজ-খবর নিয়েছি। এটলিষ্ট তাদের সন্তান হারানোর যে শূন্যতা, সেই শূন্যতা যেন আমাদেরকে দিয়ে একটু হলেও পূর্ণতা পায়-এই কাজগুলো আমরা এখনও করে যাচ্ছি।

বাসস: বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়েছে বলে কি মনে করেন?

মুহিব্বুল্লাহ: এই আন্দোলনে জনগণ যোগ দিয়েছিল তাদের অধিকার ফিরে পাবার জন্য। তারা তো কেউ অধিকার পেত না, অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু এখনো পুরোপুরি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ একটা সিস্টেম, মানে রেজিম। ১৭ বছরের রেজিম সেখানে ছিল, একদিনে তো সেগুলো পাল্টে দেওয়া যাবে না। কারণ সেই লোকগুলোই সচিব আছে, প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় তারাই আছে। কে, কীভাবে কার পারপাস সার্ভ করছে বলা তো যায় না। 

তবে, স্বপ্নের শুরু এটা- পরিবর্তনের শুরু। অভ্যুত্থান হয়েছে বলে যে সবকিছু এখনই পরিবর্তিত হয়ে যাবে তা কিন্তু না। তবে, মানুষের মনে এখনো পজিটিভিটি আছে, কোনো একটা অনিয়ম হলে সেটি প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। আগে প্রকাশ হতো না, ধামাচাপা পড়ে যেত। কিন্তু এখন মানুষ প্রকাশ করছে, অন্যায় হলে কথা বলছে- প্রতিবাদ করছে। এ জন্যই অন্যায়কারীরা ভয় পেয়ে যাচ্ছে। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের পরিবর্তন হবে, এই বাংলাদেশ একদিন সোনার বাংলাদেশে রূপ নেবে।

বাসস: স্বৈরাচার পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কী?

মুহিব্বুল্লাহ: আমার প্রত্যাশা জনগণের অধিকার। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে রাষ্ট্র থেকে নিরাপত্তাসহ যে বিষয়গুলো আমার পাওনা থাকবে সেগুলো আমি পাব। আমি নাগরিক হিসেবে আমার ট্যাক্সের টাকা পে করব, তার পরিবর্তে সরকার থেকে যেগুলো পাওয়া দরকার সেগুলো আমি সহজে পাব। জনগণ নিরাপদে থাকবে, আমার মা-বোনেরা নিরাপদে রাস্তায় চলাফেরা করবে, কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলার শিকার হবে না। 

আমি চাকরিতে যাচ্ছি- এ ক্ষেত্রে কোনো লিংক-লবিং করার প্রয়োজন হবে না। আমি মেধা দিয়ে চাকরি পাব। যোগ্য ব্যকিরা যোগ্য জায়গায় বসবে, কেউ কাউকে হয়রানি করবে না, যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। কোথাও কোনো ঘুষ দিতে হবে না, আমার হক কেউ মেরে খাবে না, সবাই অধিকার ফিরে পাবে- এরকম একটা বাংলাদেশ চাই, আমার আর কোনো চাওয়া নেই।