ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ও বিশ্লেষণ

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৫, ১২:০০ পিএম
জুলাই অভ্যুত্থান। ছবি- সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কতটা ছিল সেটা নিয়ে বিশ্লেষকসহ অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। কেননা সে সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মুখসারিতে দেখা না গেলেও পরবর্তী সময়ে দলগুলোকে এর কৃতিত্বের দাবি করতে দেখা গেছে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নিলেও দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। আন্দোলনকালে তাদের তরফ থেকে ক্রমাগত আঙুল তোলা হচ্ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে।

যেমন- ১৭ জুলাই, ২০২৪ তারিখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের ক্যাডার বাহিনী সহিংসতা করছে সারা দেশে। বিশেষ করে ঢাকায় পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে। তাদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী সারা বাংলাদেশ থেকে এনে এই শহরে তারা গুপ্তহত্যা শুরু করেছে।’

একই দিনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেছিলেন, ‘তারেক জিয়া বিভিন্নজনকে নির্দেশ দিচ্ছেন কোটা আন্দোলনকারীদের ভেতর ঢুকে পড়ার জন্য’।

অবশ্য সেদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনে বিএনপির সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপির ‘নৈতিক সমর্থন’ দেওয়ার কথা বলেন।

সে সময় জামায়াতে ইসলামীর দিক থেকেও সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়। যদিও সমর্থন আর সম্পৃক্ততা এক কথা নয়। পরবর্তীতে তারা যেভাবে সম্পৃক্ততার কথা বেশ জোরেশোরে বলেছেন তেমনটা ৫ আগস্টের আগে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা তো মাঠে ছিলামই- ছাত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের সঙ্গে বিএনপি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ বা সংযোগ সবসময় ছিল’।

তিনি বলেন, সে সময় ঢাকা থেকে বিএনপির সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সে আন্দোলনকে বিএনপি ওউন করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পেছনে যে আমরা ছিলাম এটা গোয়েন্দারা জানত, সরকার জানত। এ জন্যই তো আমাদের ব্যান করে দিয়েছে, শিবিরকেও ব্যান করেছে। আর কোনো দলকে তো করে নাই’।

মি. তাহের বলেন, তবে তারা খুবই সচেতন ছিলেন যেন ‘এটা যে জামায়াত-শিবিরের একটা আন্দোলন এটা যেন প্রকাশিত না হয়, আমরা চেয়েছি এটা একটা সার্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্য’।

তার মতে, যদি এটা প্রকাশিত হতো যে, ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে যারা খুব একটা পছন্দ করেন না তাদের হয়তো একটা রিজারভেশন তৈরি হতো। এতে করে ‘সফলতার প্রশ্নটা আরও ডিফিকাল্ট হতে পারত। সে জন্য আমরা এই কৌশলটা নিয়েছিলাম যেন সব শ্রেণির মানুষের পার্টিসিপেশন নিশ্চিত হয়’।

অবশ্য এ আন্দোলনে বিএনপি বা জামায়াত ছাড়াও বামপন্থি ও ইসলামপন্থি দলগুলোকেও বেশ সক্রিয় দেখা গেছে। সক্রিয় থাকার দাবি করে তারা বলেছে, এ জন্য আন্দোলন দমনে সরকার কঠোর হয়েছিল এবং প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে বল প্রয়োগ করেছিল।

তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে কৃতিত্ব দাবি নিয়ে রয়েছে অনেক ধরনের ব্যাখ্যাও।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির যা বলেছেন সেটা থেকেও বোঝা যায় যে, জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কাউকে সম্মুখ সারিতে দেখা গেলে তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা সেভাবে নিশ্চিত করা যেত না।

অনেকটা একই কথা বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার প্রশ্নে তিনি নেতৃত্ব ও তৃণমূল পর্যায়ের বিষয়ে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করেন।

তিনি বলেন, আন্দোলনের কোনো পর্যায়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আমাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দলের যারা তৃণমূলের নেতাকর্মী রয়েছে তারা এই অভ্যুত্থানে, আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে’।

এক গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের লোকের অংশগ্রহণ থাকলেও তারা তাদের দলীয় পরিচয়ে আসেনি, কারণ দল হিসেবে সামনে আসলে তারা সেভাবে জনসমর্থন পেতেন না।

৫ আগস্টের আগে যেভাবে আন্দোলনে বহু পক্ষ এক হয়েছিল, এক বছর পর এসে একই সময়ের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার বয়ান তৈরি হয়েছে। এসব বয়ানে জুলাই আন্দোলনে কৃতিত্বের দাবি থাকলেও বিশ্লেষকেরা সেসব দাবির উদ্দেশ্য বা কারণ ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, ‘আন্দোলন সফল হলে তখন সবাই এর কৃতিত্ব নিতে চায়।

আন্দোলন চলার সময় তারা এই দাবিগুলো করেন নাই। কারণ তারা দ্বিধায় ছিলেন। তাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল আন্দোলন সফল হবে কি না’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজার মতে, কৃতিত্বের দাবি আসন্ন নির্বাচনের আগে তরুণদের নিজ দলে ভেড়ানোর চেষ্টার অংশ। এমনকি অভ্যুত্থানে সরাসরি যাদের সামনে দেখা গেছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিকেও সেদিক দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে হচ্ছে।

আবার এখনকার কৃতিত্ব দাবির পেছনে রাজনৈতিক পর্যায়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জায়গা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।

তার দৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলো পরিচয় গোপন রেখে আন্দোলন করেছেন, আবার এখন সরকারের ওপরে এর ভিত্তিতে বেশ প্রভাব রাখছেন। অথচ যদি তাদের গ্রহণযোগ্যতা এতটা বেশি থাকত তাহলে আন্দোলনে পরিচয় গোপন রাখার প্রয়োজন পড়ত না মনে করছেন মিস নাসরীন।

অবশ্য কৃতিত্বের দাবি যে, শুধু রাজনৈতিক দলগুলো করেছে তেমন না। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বলে পরিকল্পনার কৃতিত্ব দিয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার সেই বক্তব্যই প্রশ্ন, বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজনের সুযোগ তৈরি করেছে।

তবে এটি একটি প্রচলিত বাস্তবতা যে সাফল্যের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব যেভাবে দাবি করা হয়, ব্যর্থতার দায়ভারের ক্ষেত্রে তেমনটা কাজ করে না।