এবার সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে উদযাপিত হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব, শারদীয় দুর্গাপূজা। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানিয়েছে।
গত বছর পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৪৬১টি। সেই হিসাবে এবার ১ হাজার ৮৯৪টি পূজামণ্ডপ বেড়েছে। রাজধানী ঢাকাতেও পূজার সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর ঢাকায় ২৫৯টি পূজা অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে গত বছর হয়েছিল ২৫২টি।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পূজা কমিটির নেতারা। সভায় মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।
লিখিত বক্তব্যে আগামী শনিবার দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে পূজা শুরু হবে বলে জানানো হয়। এরপর রোববার মহাষষ্ঠী, সোমবার মহাসপ্তমী, মঙ্গলবার মহাষ্টমী, বুধবার মহানবমী এবং বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী অনুষ্ঠিত হবে। বিজয়ার দিন বিকেল তিনটায় ঢাকাসহ সারা দেশে শোভাযাত্রা বের করা হবে। এ বছর দেবীর আগমন হবে গজে (হাতি) এবং গমন দোলায় (পালঙ্কে), যা শাস্ত্র অনুযায়ী বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
সভায় জানানো হয়, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠকে পূজা আয়োজকদের উদ্বেগ তুলে ধরা হলে তারা আশ্বস্ত করেন যে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে পূজার প্রস্তুতির মাঝেই দেশে ১৩টি জেলায় দুর্গাপ্রতিমা ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে সভায় উল্লেখ করা হয়। এসব জেলা হলো: কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে এবং অনেক দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তার করেছে।
সভায় বলা হয়, শুধু পূজার সময় নিরাপত্তা দিলেই হবে না, সংখ্যালঘুদের জন্য ৩৬৫ দিনই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজে সহনশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করাও জরুরি। সহিংসতার অবসান ঘটাতে হলে রাষ্ট্রীয় নীতির পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি মণ্ডপে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলে ধরতে বলা হয়েছে—প্রথমত, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা পূজার আগে প্রত্যাহার করতে হবে; দ্বিতীয়ত, সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু শিক্ষক ও কর্মচারীদের জোরপূর্বক পদচ্যুতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় আট দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারি ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন তৈরি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ছুটির ঘোষণা।
সারা দেশে পূজামণ্ডপগুলো সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য ২২ দফা নির্দেশনাও দেওয়া হয়। পূজার আয়োজন ও উদ্যাপনে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রনেতাদের সম্পৃক্ত করা, নির্ধারিত দিনে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন করা, দুর্গম অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পূজা আয়োজন করা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো কর্মকাণ্ড না করার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি ইভটিজিং, ছিনতাই বা অন্য কোনো অপরাধের ঘটনায় আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে বলা হয়।
গুজব ও অপপ্রচার থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে ৯৯৯-এ ফোন করে বা স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে বলা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর এবং উপদেষ্টা, আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী। তারা পূজাকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয়গুলো গুরুত্বসহ তুলে ধরেন।