রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রস্তাব, আইন বা রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর জনগণের সমর্থন আছে কি নেই তা যাচাইয়ের জন্য ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ সন্নিবেশিত ব্যালটের মাধ্যমে যে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় তাকে গণভোট বলে। ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’-তে সিল দিয়ে জনগণ তার সম্মতি জানায়।
জাতিসংঘের সংবিধান প্রণয়নসংক্রান্ত নথি এবং দেশের আগের ভোটগুলোর ধরন পর্যালোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংশোধন, কোনো আইন তৈরি বা বাতিল এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। গণমানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকে বিধায় এই প্রক্রিয়া গণভোট নামে পরিচিত।
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে অবিলম্বে সরকারি আদেশ জারি করে একটি গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করেছে। গণভোটের ব্যালটে দেওয়ার জন্য কমিশনের যে প্রশ্ন সুপারিশ করেছে সেটি হলো : ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তপশিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
গণভোট অনুষ্ঠিত হলে এই প্রশ্নে ভোটাররা আলাদা ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জানাবেন, তারা সনদটি সমর্থন করেন কি না। এরপর যে দল পরবর্তী সংসদ গঠন করবে, তারা সনদ বাস্তবায়ন করবে।
জাতীয় কোনো ইস্যুতে জনগণের মতামত জানতে এ ধরনের গণভোটের উদাহরণ অনেক দেশেই আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এর আগে তিনবার হয়েছে গণভোট। দুটি গণভোটের ধরন ছিল প্রশাসনিক আর একটি সাংবিধানিক— এই ছিল বাংলাদেশের তিন গণভোটের ধরন।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে গণভোট ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচিতে জনগণ আস্থা রাখেন কি না, সেই প্রশ্নে। এতে ভোট পড়েছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ, তার মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ আয়োজিত গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থার চিত্র প্রদর্শন। সেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৭২ শতাংশ; ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ।
সাংবিধানিক গণভোটটি হয়েছে ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। মূলত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থায় যাওয়ার ব্যাপারে জনরায় জানাতে আয়োজিত ওই গণভোটে প্রশ্ন ছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?’ ৮৪ শতাংশ ভোটার এতে অংশ নেন, যার মধ্যে ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ আমলে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছর হাইকোর্ট সেটি পুনর্বহালের রায় দিয়েছেন। তবে এটি আবার সংবিধানে যুক্ত করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেহেতু বর্তমানে সংসদ নেই তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে গণভোট আয়োজনে আদেশ জারির একটি সুপারিশও করেছে ঐকমত্য কমিশন।
জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ এর খসড়া-১ এ বলা হয়েছে, ‘যেহেতু ওই গণভোট অনুষ্ঠানের পূর্বে জনগণের জ্ঞাতার্থে এবং ওই সাংবিধানিক পরিষদের দায়িত্ব সম্পাদনের সুবিধার্থে জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবসমূহের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা প্রয়োজন; এবং যেহেতু উপরে বর্ণিত মতে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন সম্পন্ন করিবার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা একান্ত প্রয়োজন, সেহেতু সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এই আদেশ জারি করিল।’
অর্থ্যাৎ, অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজন করবে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোটে যদি প্রস্তাব পাস হয় তাহলে পরবর্তী সংসদ হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’। যারা ২৭০ দিন বা ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন