ঢাকা শুক্রবার, ০২ মে, ২০২৫

ঢাকা শহর কেন পিছিয়ে থাকবে

রেজাউল করিম খোকন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪, ০২:৫৬ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকারে
এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর আহারে...

জনপ্রিয়, আলোচিত ব্যান্ড চিরকুটের বিখ্যাত শ্রোতাপ্রিয় একটি গান রয়েছে এই শহরকে নিয়ে। এখন বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহর, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শহর, বিশ্বের বাসের অযোগ্য শহর কিংবা দুর্ভোগের শহর, যানজটের শহর, ব্যয়বহুল জীবনযাপনের শহর প্রভৃতি তকমায় ভূষিত হয় আমাদের সবার প্রাণের শহর প্রিয় শহর ঢাকাকে। এর চেয়ে কষ্টের অনুভূতি আর কী হতে পারে? বাসযোগ্যতার সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান পিছিয়ে থাকছে সবসময়। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোর মতো সূচকের আলোকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর নিয়ে জরিপ করা হয়। ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সারা দেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদণ্ডে যথেষ্ট নয়। বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে, অবকাঠামো খাতে এগোতে পারছে না। ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। বিশেষ করে গত এক দশকে অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ এক জায়গায় আটকে আছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না। বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। সরকার বাসমালিকদের কাছে জিম্মি। এই শহরকে বাঁচাতে হলে উন্নতমানের বাস চালু করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মেগা প্রকল্পে আগ্রহ বেশি। ফলে ঢাকায় টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। ঢাকা কেন পিছিয়ে যাচ্ছে, সেটার জবাব কেউ দেয় না। অবকাঠামো খাতে চরমভাবে খারাপ করছে বাংলাদেশ। শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, বাসগুলো যাত্রীর জন্য মারামারি করে, এটাকে গণপরিবহন বলা যায় না। যে পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতেও বাসযোগ্যতায় খুব বেশি উন্নতি হবে না। ঢাকায় ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও বাসযোগ্যতায় অগ্রগতি হচ্ছে না, যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো পরিকল্পিত ও টেকসই হচ্ছে না।

ঢাকার অবস্থান ভিয়েনার মতো করা সম্ভব হবে না বলে নগর-পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন। তবে তারা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ঢাকামুখী অভিগমনের হার কমানো এবং বাসযোগ্যতায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিকে থাকার কারণ নির্ধারণ করে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও টেকসই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সূচকে উন্নতি করা সম্ভব। ঢাকার বাসযোগ্যতায় পিছিয়ে থাকার পেছনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর প্রকট সমন্বয়হীনতা অনেকাংশে দায়ী। গত এক দশকে ঢাকায় যানবাহন বেড়েছে ৩ শ শতাংশ। কিন্তু সড়ক নেটওয়ার্ক বাড়েনি। নগর সংস্থায় দুর্নীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দুর্বল এবং নিজেদের নাগরিক অধিকারের জন্য যে শহরে আন্দোলন করতে হয়, সেখানে বাসযোগ্যতা কম থাকবেই। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরকে বাইপাস করে যাওয়ার কথা, অথচ সেটি শহরকে ধ্বংস করতে করতে যাচ্ছে। একটা শিশুপার্ক বছরের পর বছর বন্ধ। সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাসযোগ্যতায় কিছুটা উন্নতি সম্ভব। রাজধানী ঢাকা শহরে নানা আশঙ্কা বুকে চেপে রেখে আমরা দিন-রাত পার করছি। দিনে দিনে রাজধানী ঢাকা আয়তন যেভাবে বাড়ছে তেমনি বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়তি মানুষের চাপে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। নানা সংকটে জর্জরিত নগরবাসীর নাভিশ্বাস চরমে উঠছে। যানজট, পানি-গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট, মাদকের আগ্রাসন, চুরি ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মশার উপদ্রব  প্রভৃতি সমস্যাকে নিত্যসঙ্গী করে বসবাস করছেন সবাই। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, ছিন্নমূল বস্তিবাসী সবাইকে এক ধরনের অস্থিরতা, অতৃপ্তি, অশান্তি, অস্তুষ্টি নিয়ে থাকতে হচ্ছে এই শহরে। এত সমস্যা, সংকট, অস্বস্তি, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার কথা জানার পরও প্রতিদিনই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে পা রাখছেন অগণিত নারী-পুরুষ। দারিদ্র্যের কারণেই যে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হন তা বলা যায় না এখন। সচ্ছলতা থাকার পরও আজকাল অনেকেই গ্রাম কিংবা মফস্বল শহর ছেড়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং মানসম্মত জীবন যাপনের আশায় ঢাকায় চলে আসছেন। গ্রামগুলো আগের চেয়ে অনেকটা উন্নত হলেও সামাজিক কাঠামোতে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন হয়নি। ভিলেজ পলিটিক্স এখন আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রাণহানি ঘটছে। সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। গ্রামীণ সমাজ জীবনে অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে শহরে চলে আসছেন, বাসাভাড়া করে পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠছেন। আবার সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষার ব্যাপারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে কেউ কেউ শহরমুখী হচ্ছেন। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে রাজধানী ঢাকা বেসামাল একটি নগরীতে পরিণত হয়েছে, এ কথা সবাই স্বীকার করছেন।

এ বছরও ভারি বৃষ্টিপাত হলেই জলজট হওয়ার আশঙ্কাটা রয়ে গেছে। ফুটপাত পথচারীবান্ধব করার ঘোষণা দিয়েছিলেন দুই মেয়রই। কিন্তু এখনো ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দখল করে আছে দোকানপাট। শুধু তাই নয়, যখন-তখন যে কেউই তাদের ইচ্ছেমাফিক শহরের ফুটপাতে দোকান তুলছেন, পসরা সাজাচ্ছেন। এই দখল প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়নি। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই উচ্ছেদের জায়গাগুলো আবার দখল হয়ে যায়। বাস্তবতা হলো, হকারদের পুনর্বাসন ছাড়া ফুটপাত পথচারীবান্ধব করা যাবে না। এই শহরে সারি সারি ভবন আর রাস্তাঘাটের বিস্তৃতি ঘটছে, কিছু এলাকার চাকচিক্য সৌন্দর্য বাড়ছে, তবে সেই তুলনায় বস্তির কোনো উন্নয়ন হয়নি। সুযোগ-সুবিধাও বাড়েনি, খেলার মাঠগুলোর বেহাল সহজেই চোখে পড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মাঠগুলোর নজরদারি করার কেউ নেই। খেলার মাঠে নেই খেলাধুলার পরিবেশ। ধানমন্ডি এলাকায় একটি খেলার মাঠকে নিয়ে দারুণ তোলপাড় হয়েছে গত সরকারের আমলে।

ঢাকা নগরীর বিভিন্ন  জায়গায় এ রকম বহু খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে কিংবা বেদখল হয়ে গেছে। শিশু-কিশোররা খেলার মাঠের অভাবে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে। তাদের যথার্থ মানসিক, শারীরিক  গঠন এবং বিকাশ ঘটছে না। যে কারণে কিশোরদের গ্যাং কালচারের  দৌরাত্ম্যে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা শহরে খেলার মাঠের অভাব দূর করতে হবে। আসলে যানজট, জলজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অনেক গুরুত্বপূর্র্ণ ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশন এখন আর কাজ করার সুযোগ নেই। ওষুধ ছিটানোর পরও ঢাকার মশার উপদ্রব কমেনি। মশার যন্ত্রণা ঢাকা শহরবাসীর জীবনে চরম অস্বস্তি হয়ে আছে এখনো।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর এখন একটি দর্শনহীন, ভিশনহীন ও সমন্বয়হীন দূষিত নগরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট নগর দর্শন, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এ শহর নিয়ে আমাদের সামনে স্পষ্ট কোনো ভিশনও নেই। নগরীতে পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার করে, দূষণমুক্ত পরিবেশ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ড্রেনেজ সমস্যার সমাধানসহ নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে শপিং সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বাণিজিক কার্যালয়। আবাসিক এলাকাগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ঝুলন্ত তারের নগরীতে পরিণত হচ্ছে শহরগুলো। মাস্টার প্ল্যানের বাইরে মার্কেটগুলোতে অনঅনুমোদিত দোকানপাট তুলে অরাজকতা তৈরি করছে কিছু অসাধু চক্র। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে, জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। কি বৃষ্টি কি বর্ষাকাল যে সংস্থার যখন খুশি রাস্তা কাটাছেঁড়া করছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব কার তা নিয়ে চলে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। সাধারণত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে পারে না সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে। বিশেষ করে উন্নয়নমূলক কাজকর্মে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আমরা সব সময়ই প্রত্যক্ষ করে আসছি। এটাকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

এই শহরে আমরা যারা বাস করছি, তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে শহরটিকে সুন্দর আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে। এ শহরকে নিজ বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ভালোবাসতে হবে। তাহলেই একে পরিচ্ছন্ন, বসবাস উপযোগী সুন্দর নগরীতে পরিণত করা সম্ভব হবে। পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ঢাকা গড়তে নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতাই সফলতার শক্তি। এই নগরীকে স্বপ্নের মতো সুন্দর, বাসযোগ্য এবং আরামদায়ক করতে প্রত্যেক নগরবাসীর নিজস্ব কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যে যার অবস্থান থেকে সেই দায়িত্বগুলো পালন করে গেলে আমাদের এই প্রিয় শহর কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারে না, বিশ্বের বাসের অযোগ্য শহরের কিংবা দুর্ভোগের শহরের তালিকায় ঠাঁই পেতে পারে না। দুঃস্বপ্নের বোঝা আর অনাগত বিপদের শঙ্কা বুকে বয়ে আমরা প্রতিটি দিন পার করতে চাই না আর। অনেক সম্ভাবনা এবং সুন্দরের হাতছানি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা মনেপ্রাণে চাই, একটি চমৎকার বাসযোগ্য স্বস্তিকর জীবনের শান্ত সুনিবিড় আন্তর্জাতিক মানের শহর হিসেবে গণ্য হোক বিশ্বজুড়ে।