ঢাকা বুধবার, ০৪ জুন, ২০২৫

পানির রাজনীতি ও বাংলাদেশের বন্যা : প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূমিকা ও আমাদের করণীয়

ড. মো. মিজানুর রহমান
প্রকাশিত: জুন ২, ২০২৫, ০৫:২০ পিএম
অর্থনীতিবিদ ড. মো. মিজানুর রহমান।

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন একটি অববাহিকায় অবস্থিত, যার ওপর প্রভাব ফেলে প্রতিবেশী দেশ- বিশেষ করে ভারতের নদী ব্যবস্থাপনা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়, বিশেষ করে ভারতের উজানে অপ্রত্যাশিতভাবে পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কি বাংলাদেশকে না জানিয়ে পানি ছেড়ে দিয়েছে? আর যদি তা করে থাকে, তাহলে তা কি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন নয়? এবং এর মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়ই-বা কী?

বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি (মে ২০২৫)

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও এখন সে পরিচিতি আর কেবল জল-সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্যের নয়, বরং আশঙ্কার কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (BWDB) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মে (২০২৫) মাসে সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই মাত্রা জুন-জুলাই মাসে বর্ষা প্রবল হলে দ্বিগুণ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে ফ্লাড ফোরকাস্টিং অ্যান্ড ওয়ার্নিং সেন্টার (FFWC)।

বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, জামালপুর ও গাইবান্ধা এলাকায় যে বন্যা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে, তা যদি অতিরিক্ত বর্ষণের সঙ্গে মিশে যায়, তাহলে জুনের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে এক ‘উচ্চমাত্রার বন্যা’ ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ করে যে প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে, তা কেবল প্রাকৃতিক নয়—বরং এর পেছনে রয়েছে কূটনৈতিক গাফিলতি, আঞ্চলিক দায়িত্বহীনতা এবং দীর্ঘস্থায়ী পানি বণ্টন সমস্যার সুনিপুণ প্রতিচ্ছবি।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে তিস্তা, ধরলা, করতোয়া ও বরাক-কুশিয়ারা নদীর উজানে বিশেষ করে, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ (তিস্তা), ধলই বাঁধ (বরাক-কুশিয়ারা), কুশিয়ারা ব্যারাজসহ একাধিক স্থানে সঞ্চিত অতিরিক্ত পানি, আগাম কোনো বার্তা না দিয়ে একযোগে ছেড়ে দেওয়ায় পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মানুষের বসতবাটি, জমির ফসল, মাছ, পশুসম্পদ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই ভয়াবহতার দায় কার? ভারতের উজানে বাঁধ, ব্যারাজ ও জলাধার রয়েছে অন্তত ৪০টির মতো, যার মধ্যে তিস্তার গজলডোবা ব্যারাজ এবং বরাক নদীর ধলই বাঁধ অন্যতম।

ভারতের আবহাওয়া সংস্থা মে মাসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টির সতর্কতা দিলেও, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে (The Daily Star, ৩০ মে ২০২৫), ভারতের পক্ষ থেকে এবারের পানি ছাড়া সংক্রান্ত কোনো “early warning” পাঠানো হয়নি। অথচ ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের অন্যতম মূল দায়িত্বই ছিল এ ধরনের তথ্য বিনিময়। 

আবার ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের পানি ব্যবহারের আন্তর্জাতিক আইন, ‘International Watercourses Convention’ অনুযায়ী, উজান রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে পানি ছাড়ার আগে নিচের রাষ্ট্রকে আগাম অবহিত করা। UN Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses (1997) এই সনদের ধারা ৫ অনুযায়ী যৌথ নদীর পানির ন্যায্য ও সমতুল্য বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

ধারা ৭ অনুযায়ী, নিচু অববাহিকার রাষ্ট্রের ক্ষতি না হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আছে। ধারা ১১ অনুযায়ী, পানি ব্যবস্থাপনায় অন্য রাষ্ট্রকে আগাম অবহিত করার বিধান আছে। ভারত এই কনভেনশন স্বাক্ষর করলেও এখনো অনুমোদন করেনি, তবে ‘customary international law’ হিসেবে এটিকে বাধ্যতামূলক ধরা হয়।

অর্থাৎ একটি রাষ্ট্র যদি জেনে-শুনে তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রে মানবিক বিপর্যয় ঘটায়, তবে তা ‘transboundary harm’ হিসেবে বিবেচিত হয় (Trail Smelter arbitration, 1941)। ভারতের পানি ছাড়া এই তত্ত্বে পড়ে যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।

তবে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, ডুম্বুর বাঁধের গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে এবং এটি ইচ্ছাকৃত ছিল না। এই বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য আশ্বস্তকর নয়, কারণ আগাম সতর্কতা ছাড়া পানি ছেড়ে দেওয়া দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। 

বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত উজানে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ এবং অনিয়ন্ত্রিত পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটে ভুগছে। এ পরিস্থিতি দেশের কৃষি, অর্থনীতি ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, বন্যার কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ শতাংশ নদীর পানি বর্ষা মৌসুমে ভারতের দিক থেকে আসে।

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি বাস্তবায়নে নিয়মিত ৩০ শতাংশ অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে (JRC Reports)। গত পাঁচ বছরে প্রতি বছর গড়ে তিন-চার বার মাঝারি থেকে বড় ধরনের বন্যা দেখা দিয়েছে। ২০২২ সালে সিলেট অঞ্চলে জুন-জুলাইয়ে যে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল, তাতে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। 

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর ও কালসি বাঁধ থেকে আগাম কোনো সতর্কতা ছাড়াই পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলার প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হন এবং ৫০ হাজারেরও বেশি পরিবার বাস্তুচ্যুত হন।

বন্যায় ২৯৬,৮৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৪,৪২১ কোটি টাকা। প্রতি বছর বন্যার কারণে বাংলাদেশে ৬০০-১০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় (এডিবি, ২০২২)।

এবার ২০২৫ সালে এখনো বর্ষা মৌসুম পুরোদমে শুরু হয়নি, তার আগেই পানি প্রবেশের যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে চলতি বছরে প্রায় এক কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এরই মধ্যে সিলেট অঞ্চলে মে ২০২৫-এর বন্যায় প্রায় ৪ দশমিক ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন (Disaster Management Bureau)। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বন্যায় জানমালের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। ফসলের ক্ষতির মাত্রা হবে সবচেয়ে গভীর। 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জানিয়েছে, মে মাসে ধানের যে ফসল মাঠে রয়েছে—বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের বোরো ধান—তার প্রায় ৩০ শতাংশ এখনো কাটেনি। পানি ঢুকে গেলে এই ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন বীজতলার প্রস্তুতি, সবজির আবাদ ও গবাদি পশুর খাদ্য সংরক্ষণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এবারের আগাম বন্যায় শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ ও সিলেটেই ফসল ও পশু সম্পদের ক্ষতি দাঁড়াতে পারে ২,৪০০ কোটি টাকা।

মানবিক দিক থেকেও পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, বন্যার পানিতে কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও চর্মরোগ ছড়াতে পারে। পানিবন্দী মানুষেরা বিশুদ্ধ পানির অভাবে এবং খাদ্য সংকটে পড়ছেন। এরই মধ্যেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে জায়গা সংকট দেখা দিয়েছে। কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম অঞ্চলে কয়েকশ স্কুলে ক্লাস স্থগিত করতে হয়েছে।

বন্যায় ক্ষতি মোকাবিলায় করণীয়

চলমান বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং এর বিস্তার রোধে জরুরি ভিত্তিতে বন্যাকবলিত অঞ্চলে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা, পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বন্যার পানিতে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে মেডিকেল টিম মোতায়েন করে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ বিতরণ, টিকা কর্মসূচি এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম চালানো উচিত। বন্যাক্রান্ত পরিবারগুলোর জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে চাল, ডাল, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি বন্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জরুরি।

ভয়াবহ বন্যায় দেশের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ কৃষক তাদের ফসল, কৃষিযন্ত্র, খামার পশু এবং চাষের মাছ হারিয়েছেন। এই ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত ও নির্ভুলভাবে নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য প্রণোদনাভিত্তিক কৃষি প্যাকেজ ঘোষণা করে তা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের হাতে পৌঁছাতে হবে।

এই প্যাকেজে মানসম্পন্ন বীজ, সার, কৃষিযন্ত্রপাতি এবং অল্প সুদে কৃষিঋণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বিশেষ করে জলমগ্নতা সহনশীল ধানজাত যেমন ব্রি ধান ৫২, ৭১ কিংবা ৯৩ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি রেইজড বেড পদ্ধতি, ভাসমান বাগান, এবং ধাপে ধাপে চাষাবাদ ইত্যাদি জলবায়ু-সহনশীল কৃষিপদ্ধতির প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

কৃষিজমিতে জমে থাকা বন্যার পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে নতুন করে চাষে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। 

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খামার পশু এবং মৎস্য খাত পুনরুদ্ধারে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পশু বিতরণ, পশুর খাদ্য ও ওষুধ সহায়তা, এবং ভেটেরিনারি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন প্রয়োজন। একইভাবে মাছচাষীদের জন্য পোনা মাছ ও প্রাথমিক উপকরণ সরবরাহ করে তাদেরও চাষে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

কৃষিপণ্য বিপণন ও বাজারব্যবস্থা সচল রাখার জন্য বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামতের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ কৃষিপণ্য বাজার চালু করতে হবে, যাতে কৃষকরা সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারেন এবং ন্যায্য দাম পান। প্রয়োজনে মোবাইল অ্যাপ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষি বিপণন সহজতর করা যেতে পারে।

জাতীয় পুনর্বাসন প্রচেষ্টায় উন্নয়ন সহযোগী, যেমন- FAO, IFAD, ADB, JICA ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে রেজিলিয়েন্ট ফার্মিং চালু করা যেতে পারে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ এনজিও এবং কৃষক সংগঠনগুলোকেও এই উদ্যোগের অংশীদার করা উচিত।

কৃষি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী ‘জাতীয় কৃষি পুনর্বাসন টাস্কফোর্স’ গঠন করে টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন শুধু ক্ষতি পুষিয়ে নেবে না, বরং দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটি হবে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

বন্যা রোধে করণীয়

প্রথমত, বাংলাদেশের উচিত, বন্যা মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। পাশাপাশি বাংলাদেশ যদি চায়, তবে আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের এই আচরণকে ‘পরিবেশগত অপরাধ’ হিসেবে তুলে ধরতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ‘বেসিন-ভিত্তিক সমন্বয়’ ছাড়া এ সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান নেই। এই মুহূর্তে দরকার ভারতের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ‘রিভার ইনফর্মেশন শেয়ারিং চুক্তি’, যেখানে প্রতিটি বাঁধ থেকে কখন, কত পানি ছাড়া হবে, তা জানিয়ে দিতে হবে ৭২ ঘণ্টা আগে। 

বাংলাদেশের জন্য এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক পানিনীতি মেনে চলার জন্য ভারতের প্রতি জোরালো কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার এবং অভ্যন্তরীণভাবে পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের কৃষি ও অর্থনীতিকে রক্ষা করার। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক ফোরামে বিশেষ করে, জাতিসংঘ, SAARC, BIMSTEC-এর মতো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার মাধ্যমে ভারতের পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি উত্থাপন করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।
 
বাংলাদেশ চাইলে International Court of Justice (ICJ) পরামর্শ গ্রহণ সম্ভব, তবে মামলার জন্য দুই রাষ্ট্রের সম্মতি প্রয়োজন। UNESCO–International Hydrological Program (IHP) পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা ও সহায়তা দিয়ে থাকে। South Asian Association for Regional Cooperation (SAARC) আঞ্চলিক আলোচনা ও সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে। UN Human Rights Council (UNHRC) পানি সংকটকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।

তবে আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগ দিলে রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন বাড়তে পারে, এটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা Early warning system ভারতীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করা (real-time telemetry); রিভার ব্যারিয়ার সিস্টেম ও বাঁধ উন্নয়ন; পানি সংরক্ষণ হ্রদ স্থাপন এবং ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট অবকাঠামো গড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে কূটনৈতিক চুক্তি ও নজরদারি বাড়াতে পারে, যেমন ভারতের সঙ্গে তিস্তা ও অন্যান্য নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত সম্পাদন করা।

পরিশেষে বলতেই হয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা, সরকারের সক্রিয়তা এবং জনগণের সচেতনতা, এই ত্রয়ীর সমন্বয় ছাড়া এই দুর্যোগের চক্র থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। প্রয়োজন এখন একটি ‘পানি কূটনীতি’, যেখানে শক্তি নয়, সমতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার নদী রাজনীতি।

বিশেষ করে, এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক পানিনীতি মেনে চলার জন্য ভারতের প্রতি জোরালো কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার এবং অভ্যন্তরীণভাবে পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের কৃষি ও অর্থনীতিকে রক্ষা করার। 

দেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় একটি সুসংহত ও কার্যকর পানি ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন জরুরি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

তবে তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেট পরিকল্পনায় বন্যা প্রতিরোধে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার আলাদা বরাদ্দ থাকা জরুরি।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট