মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এ এইচ এম ফারুক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম

আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাস

বিপর্যস্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

এ এইচ এম ফারুক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম

এ এইচ এম ফারুক। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

এ এইচ এম ফারুক। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চলমান সংঘাত, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপত্তা–ঝুঁকি সৃষ্টি করে আসছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে আরাকান আর্মি (এএ) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, সামরিকভাবে সক্ষম ও এলাকা–নিয়ন্ত্রণকারী এক সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট, সীমান্তে বর্বর উসকানি এবং শরণার্থী স্রোতের পাশাপাশি এই গোষ্ঠীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে মাদক পাচার ও মাদক অর্থনীতির উপর তাদের গভীরভাবে নির্ভরশীলতা।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সীমান্তের দুর্বল অংশ, উপকূল ও পাহাড়ঘেরা অঞ্চল এবং বিশাল যুব জনগোষ্ঠী—সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে এই মাদক সন্ত্রাসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সাম্প্রতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষণগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে, বর্তমান গতিপথ অব্যাহত থাকলে আরাকান আর্মির মাদক অর্থনীতি বাংলাদেশের উপর ভবিষ্যতে গভীর সামাজিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এ প্রবদ্ধে আরাকান আর্মির মাদক কার্যক্রমের প্রকৃতি, বিস্তার, বাংলাদেশের উপর এর প্রভাব ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ঝুঁকি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আরাকান আর্মির উত্থান মাদক অর্থনীতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক

সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) হলো মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের ক্ষমতা ও ভূ-রাজনীতির এক নতুন কেন্দ্রবিন্দু। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরাকান আর্মি দ্রুতই মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান নন-স্টেট আর্মড অ্যাক্টরে পরিণত হয়।

রাখাইনে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামে তারা জনগণ, শাসন ব্যবস্থা, ট্যাক্সিং, বিচারব্যবস্থা ও বহু প্রশাসনিক কাঠামোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, তাদের অর্থায়নের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা, আইস/ক্রিস্টাল মেথ, তেল ও গ্যাস রুটে অনানুষ্ঠানিক ট্যাক্সিং, সীমান্ত বাণিজ্যে চাঁদাবাজি, মানব পাচার ও অপহরণ র‌্যাকেট এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাচার।

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের শান ও কাচিন রাজ্যের সিন্ডিকেট এবং তৃতীয় দেশের অপরাধচক্রের সঙ্গে আরাকান আর্মির যৌথ অপারেশন তাদেরকে দক্ষিণ–এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী মাদক–কার্টেলে পরিণত করেছে। মিয়ানমার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের উল্লেখযোগ্য সামরিক অগ্রগতি রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে এনে দিয়েছে।

তবে এই সাফল্যের আড়ালে তাদের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে মাদক ব্যবসা, বিশেষত ইয়াবা (মেথামফেটামিন) এবং আইস (ক্রিস্টাল মেথ) চোরাচালান। এই মাদক সাম্রাজ্যের প্রধান গন্তব্য প্রতিবেশী বাংলাদেশ। যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে।

আরাকান আর্মি তাদের সামরিক সক্ষমতা বজায় রাখা, অস্ত্র সংগ্রহ, যোদ্ধাদের রসদ জোগানো এবং সংগঠনের অন্যান্য খরচ নির্বাহের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন মেটাতে মাদক কারবারকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে।

রাখাইন রাজ্যের যেসব অঞ্চল বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোর অধিকাংশই কুখ্যাত 'ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল' অঞ্চলের অংশ, যা আন্তর্জাতিক মাদক উৎপাদন ও পাচারের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তারা এই দুর্গম অঞ্চলে মাদক উৎপাদনে সহায়তা করে এবং আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে।

ভৌগোলিক নৈকট্য এবং মাদকাসক্তির উচ্চ হারের কারণে বাংলাদেশ তাদের মাদকের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কক্সবাজারের সীমান্ত, বিশেষ করে নাফ নদী এবং উপকূলীয় সমুদ্রপথ মাদক চোরাচালানের প্রধান রুট।

তাদের আয়ের দুটি প্রধান ধারা রয়েছে; প্রথমত, আন্তর্জাতিক মাদক গ্রুপগুলোকে বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের নিয়ন্ত্রিত রুট ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বিপুল অঙ্কের কমিশন আদায় করা এবং দ্বিতীয়ত, নিজস্ব সক্রিয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্থল ও সমুদ্রপথে সরাসরি বাংলাদেশে মাদক পাচার করা।

মাদক পাচারে আরাকান আর্মির ভূমিকা: ইতিহাস বর্তমান বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মিয়ানমারের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম ও হেরোইন উৎপাদনকারী অঞ্চল। সময়ের সাথে সাথে, এর কেন্দ্র পশ্চিম মিয়ানমার, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে সরে এসেছে, যা ইয়াবা (একটি মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ) উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

রাখাইন অঞ্চলে মাদক উৎপাদন ও পাচারের সাথে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী, কর্পোরেট সিন্ডিকেট এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্যের যোগসূত্র দীর্ঘদিনের। আরাকান আর্মির উত্থানের আগেও এই অঞ্চল মাদক পাচারের জন্য কুখ্যাত ছিল। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আরাকান আর্মি সরাসরি মাদক উৎপাদন বা পাচারে জড়িত না হয়ে ‘কর’ বা ‘সুরক্ষা খরচ’ আদায়ের মাধ্যমে এই বাণিজ্য থেকে লাভবান হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে অবস্থিত ইয়াবা ল্যাবগুলো থেকে তারা কর আদায় করে এবং সেগুলোকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা করে।

এটি তাদের জন্য একটি উইন উইন সিচুয়্যাসন। তারা আয় করে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কারণ এই ল্যাবগুলো প্রায়শই সেনাবাহিনীর সাথে জড়িত সিন্ডিকেটগুলোর মালিকানাধীন। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি) এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে বারবার ইঙ্গিত করা হয়েছে যে রাখাইনে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো মাদক বাণিজ্য থেকে আয় করে।

স্থানীয় সূত্রগুলোও আরাকান আর্মির এই কর আদায়ের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে। বিভিন্ন ব্যক্তির গবেষণা এবং বিশেষ সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সিন্থেটিক ড্রাগ উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি এবং আরাকান আর্মির সমর্থন ও সুরক্ষা ছাড়া প্রধান মাদক উৎপাদক ল্যাব ও সিন্ডিকেট টিকে থাকা সম্ভব নয়।

এছাড়া, রাখাইনে আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে মাদক পণ্য বাংলাদেশমুখী রুটে নিরাপদে পাচার করতে সহায়তা প্রদান করে। আগে যেখানে মাদক উৎপাদন ছিল সীমান্তবর্তী সংকীর্ণ এলাকায়, এখন তা রাখাইন জুড়ে এবং রাখাইন–চিন–কাচিন সংযোগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মির সামরিক আধিপত্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাদক ব্যবসাও আরো পদ্ধতিগত, সংগঠিত, এবং শিল্পায়িত রূপ পেয়েছে।

বাংলাদেশে মাদক সন্ত্রাসের বিস্তার

ইয়াবার প্রধান গেটওয়ে হচ্ছে টেকনাফ–কক্সবাজার রুট। বাংলাদেশে যেসব রুট দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নাফ নদী ও জলসীমা রুট, টেকনাফ–হ্নীলা–হোয়াইক্যং সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি রুট এবং মেরিন রুট (সেন্টমার্টিন–চট্টগ্রাম উপকূলঘেঁষা পথ)।

এই রুটগুলো আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে পরিচালিত সিন্ডিকেটগুলোর কাছে অত্যন্ত লাভজনক। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এখানে স্থানীয় যোগাযোগ, বংশানুক্রমিক পাচার নেটওয়ার্ক ও দুর্নীতিপ্রবণ কিছু উপাদানকে ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে।

আরাকান আর্মি সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ‘লজিস্টিক হাব’ হিসেবে ব্যবহার করার কারন ক্যাম্পের ভেতর দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, মিয়ানমারে ফিরলে নিরাপত্তা হারানোর ভয়, যুবকদের সহজে মাদক পরিবহনে যুক্ত করা ও ভৌগলিক কারণে ক্যাম্প মাদক পরিবহন নোড হিসেবে আদর্শ।

নতুন ধরণের মাদক: ‘ক্রিস্টাল আইস লিকুইড ড্রাগের বিস্তার

ইয়াবার পাশাপাশি এখন হাই-পিউরিটি ক্রিস্টাল মেথ বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, যার আর্থিক লাভ বহু গুণ। মাদক অর্থনীতির এই আপগ্রেডেশন আরাকান আর্মিকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।

বাংলাদেশের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব

আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাস বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সমাজ এবং যুবসমাজের উপর বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা দেশের ভবিষ্যৎকে বিপর্যস্ত করতে পারে।

সামাজিক জনস্বাস্থ্যগত বিপর্যয়

যুবসমাজের ধ্বংস: ইয়াবা ও আইস-এর মতো মরণঘাতী মাদক সহজলভ্য হওয়ায় দেশের যুবসমাজ দ্রুত মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তি তরুণদের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের জন্য এক বিরাট হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

অপরাধ বৃদ্ধিমাদক কেনা ও সেবনের অর্থ জোগাড় করতে সমাজে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ ও খুনের মতো অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। মাদকাসক্তি পারিবারিক সহিংসতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে।

স্বাস্থ্যসেবার উপর চাপমাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

অর্থনৈতিক আর্থিক সংকট

পুঁজির বহির্গমনমাদক পাচারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি থেকে পুঁজির অবৈধ বহির্গমন ঘটাচ্ছে।

কালো টাকার অর্থনীতি: মাদকের ব্যবসা একটি বিশাল কালো টাকার অর্থনীতি সৃষ্টি করছে, যা দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে এবং অবৈধ অর্থলগ্নি ও মানি লন্ডারিং বৃদ্ধি করছে।

উৎপাদনশীলতার ক্ষতি: মাদকাসক্তির কারণে শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা কমছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় প্রবৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় নিরাপত্তা সীমান্ত সমস্যা

সীমান্তের অস্থিতিশীলতা: আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান তৎপরতা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে চরম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। সীমান্তে গোলাগুলি, অপহরণ (বিশেষত বাংলাদেশি জেলেদের) এবং অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়ছে।

সন্ত্রাস-অপরাধের সংযোগ: মাদক ব্যবসার মাধ্যমে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী আর্থিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। এই অর্থ তারা অস্ত্র ক্রয় ও তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহার করছে, যা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে।

রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবহার: মাদক পাচারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি অংশকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরো অবনতি হচ্ছে এবং স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে।

পার্বত্য অঞ্চলে সম্প্রসারণের উদ্বেগআরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংযোগের খবর পাওয়া যায়, যা দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলেছে।

কূটনৈতিক চাপ আন্তর্জাতিক ইমেজের ক্ষতি

১. আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে “মাদক ট্রানজিট নেশন” হিসেবে চিত্রিত করা হতে পারে।

২. যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর চাপ বাড়তে পারে।

৩. সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার অভিযোগে কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল হতে পারে।

চ্যালেঞ্জসমূহ

১. সীমান্তের দুর্গমতা: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অত্যন্ত দুর্গম, যা নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় বাধা।

২. আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ: রাখাইন রাজ্যের সিংহভাগ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকায় মাদকের উৎস বন্ধ করা বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

৩. স্থানীয় সিন্ডিকেটের যোগসাজশ: বাংলাদেশের ভেতরে কিছু অসাধু ব্যক্তি ও সিন্ডিকেট এই মাদক কারবারে জড়িত, যা অভ্যন্তরীণভাবে সমস্যাকে জটিল করছে।

৪. রোহিঙ্গা ইস্যু: রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর অস্থিরতা ও সেখানে মাদক পাচারে কিছু রোহিঙ্গার সম্পৃক্ততা মাদক চোরাচালানকে আরো সহজ করে দিয়েছে।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও করনীয়

আরাকান আর্মির মাদক সন্ত্রাস বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সমস্যা কেবল সীমান্ত নিরাপত্তা বা আইন-শঙ্খলার বিষয় নয়, বরং দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যগত স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে।

আরাকান আর্মির মাদক অর্থনীতির বিস্তার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি সরাসরি অস্তিত্বগত ঝুঁকি। ইয়াবা, আইস ও নতুন ধরনের সিন্থেটিক ড্রাগের প্রবাহ ইতোমধ্যেই দেশের যুবসমাজ, আইন–শৃঙ্খলা ও সীমান্ত নিরাপত্তাকে নড়বড়ে করে তুলেছে।

মাদক ব্যবসা থেকে আরাকান আর্মির অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবকে আরো মজবুত করছে, যা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। যদি এই প্রবণতা এখনই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, আগামী এক দশকে বাংলাদেশ মাদক–সন্ত্রাস ও সীমান্ত–নিরাপত্তাজনিত একটি দীর্ঘমেয়াদি ভূ–রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে।

১. সীমান্ত নজরদারি জোরদার: জানা গিয়েছে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের মাধ্যমে স্থল ও সমুদ্রপথে টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে এটা আরো শক্তিশালি করার বিষয়ে আন্তরিক থাকতে হবে।

২. মাদকবিরোধী অভিযান: মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ হতে দেখা যাচ্ছে। এ কার্যক্রম আরো জোরদার ও জোরালো করতে হবে।

৩. কূটনৈতিক তৎপরতা: সংশ্লিষ্ঠ বাহিনী ও সরকারের তরফ থেকে জানা তথ্যানুযায়ী দীর্ঘ বছর মিয়ানমারের সাথে তেমন যোগাযোগ রক্ষা সম্ভব হয়নি তাদের অনাগ্রহের কারণে। তবে কিছু বছর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে কার্যকর আলোচনা কঠিন। তবুও সবগুলো উপায় অবলম্ভন করে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সুপারিশমালা

বহুমুখী সীমান্ত সুরক্ষা: আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা, বিশেষ করে ড্রোন ও উন্নত রাডার সিস্টেম ব্যবহার করে নাফ নদী ও উপকূলীয় সমুদ্রপথে নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আসিয়ান দেশসমূহ, ভারত ও চীনের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে আরাকান আর্মির মাদক নেটওয়ার্ক ভাঙতে আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলা। বিশেষত, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল-এর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।

অভ্যন্তরীণ কঠোরতা: দেশের অভ্যন্তরে মাদকের মূল হোতা ও স্থানীয় সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে আরও কঠোর অভিযান পরিচালনা এবং তাদের আর্থিক নেটওয়ার্ক ছিন্ন করা।

জনসচেতনতা পুনর্বাসন: যুবসমাজকে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং মাদকাসক্তদের জন্য পর্যাপ্ত পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচির ব্যবস্থা করা।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিয়ন্ত্রণ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের কঠোর হাতে দমন করা এবং সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Link copied!