ঢাকা সোমবার, ০২ জুন, ২০২৫

ক্যান্সারকে হারিয়ে যেভাবে ফাইনালের মঞ্চে ফ্রানসেস্কো আচেরবি

স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২৫, ০৫:৪৩ পিএম
ফ্রানসেস্কো আচেরবি। ছবি: সংগৃহীত

ফুটবল মাঠে নায়ক হিসেবে ফ্রানসেস্কো আচেরবির উত্থান যেন এক রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এটি শুধু ফুটবলের গল্প নয়, বরং জীবনের পথে দিশেহারা এক মানুষের আত্মত্যাগ, সহনশীলতা এবং অবিচল মনোবলের এক অসাধারণ উপাখ্যান। 

বাবার মৃত্যুতে বিষণ্নতা ও মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়া, দুইবার ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ে আবার ফুটবলে ফেরা, আর ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে ৩৭ বছর বয়সে ইন্টার মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠার নায়ক হয়ে ওঠা, সব মিলিয়ে আচেরবির জীবন এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

বার্সেলোনার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ইন্টার মিলানের বিদায় যখন প্রায় নিশ্চিত, ঠিক তখনই ম্যাচের ৯৩তম মিনিটে গোল করে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন আচেরবি। 

তার সেই নাটকীয় গোলে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় এবং পরে ইন্টার ৭-৬ ব্যবধানে জয়ী হয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয়। ম্যাচ শেষে ইন্টার কোচ সিমন ইনজাগি আচেরবির এই আক্রমণের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘এই আক্রমণ ওর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল। আমি কিছুই বলিনি।’

সতীর্থ কার্লোস অগুস্তোও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে বক্সে ঢোকার শক্তি ও কোথা থেকে পেয়েছে, জানি না। কিন্তু আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। মাঠের বাইরে ওর জীবনযুদ্ধের গল্পও অনন্য। আচেরবি কখনোই হাল ছাড়ে না।’

মিলান শহর থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরে ভিজোলো প্রেদাবিস্সিতে জন্ম নেওয়া আচেরবির ফুটবল জীবন শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে পাভিয়ার হয়ে। সিরি ডি-এর ক্লাব রেনাতে ধারে এক মৌসুম কাটানোর পর তার ইতালি ভ্রমণ শুরু হয়। 

পাভিয়ার পর রেজিনা, জেনোয়া, চিয়েভো—এভাবে একসময় ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এসি মিলানের নজর কাড়েন তিনি। ২০১২ সালে প্রিয় ক্লাবে যোগ দিলেও সেই স্বপ্ন দ্রুতই ভেঙে পড়ে। 

বাবার মৃত্যুর পর তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এবং প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ শুরু করেন। আচেরবি নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘আমি তখন প্রায়ই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অনুশীলনে যেতাম।

শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলাম, তাই ভাবতাম সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আমার সবকিছু ভেঙে পড়ে। আমি খেলতেই পারতাম না।’

এরপর মিলান থেকে ধারে চিয়েভো এবং পরে সাসসুওলোতে যোগ দেন। কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাইয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধরা পড়ে টেস্টিকুলার ক্যানসার। অপারেশনের পর মাঠে ফিরলেও ডিসেম্বরে আবারও ক্যানসার ধরা পড়ে। শুরু হয় কেমোথেরাপির কঠিন লড়াই। 

আচেরবি এই কঠিন সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আশ্চর্যভাবে, এই রোগ আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে। আমি কে, আর কী চাই—তা বুঝতে পেরেছিলাম তখনই।’

এদিকে, অসংখ্য কেমোথেরাপি শেষে ২০১৪-১৫ মৌসুমে তিনি আবার মাঠে ফেরেন। সাসসুওলোর হয়ে পাঁচটি সফল মৌসুম শেষে ২০১৮ সালে যোগ দেন লাজিওতে, যেখানে কোচ ইনজাগির সঙ্গে তার দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

২০২২ সালে ইনজাগির আস্থাভাজন হিসেবেই এই যোদ্ধা ইন্টারে যোগ দেন। যদিও ক্লাবের অনেকে এবং সমর্থকদের একাংশ এতে খুশি ছিলেন না—তাদের আপত্তি ছিল তার অতীত ক্লাব এসি মিলানের সঙ্গে জড়িত থাকা নিয়ে। 

তবে আচেরবির মনোবিদ ফ্রাংকিনি তাকে ইন্টারে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিলেন এই বলে যে, ‘ওর বাবা ছিলেন ইন্টার সমর্থক। এতে অন্তত বাবার কাছাকাছি যেতে পারবে ও।’

আচেরবির প্রিয় প্রাণী সিংহ, তার শরীরে সিংহকে নিয়ে একাধিক ট্যাটু রয়েছে। বুকে ‘দ্য লায়ন কিং’, পেটে গর্জনরত সিংহ এবং হাতে ‘মাদাগাস্কার’ সিনেমার সিংহ চরিত্র অ্যালেক্সের ট্যাটু।

নিজের ফিরে আসা সম্পর্কে আচেরবি বলেন, ‘আমার শিক্ষা কখনো হাল ছেড়ো না। পড়া যাবে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই হবে। সঠিক মানসিকতা মানুষকে বদলে দিতে পারে। নিজেকে সাহায্য করতে হয়, বাইরে থেকে সমর্থন পেতে হলেও শুরুটা নিজের ভেতর থেকে করতে হয়।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি জানি না, মিউনিখে জয় কি আমার জীবনের এক চক্রের সমাপ্তি হবে কিনা। তবে আমি এমন কেউ না যে একটা ফাইনাল হারলে থেমে যাবো।’

শুধু ক্যানসারের বিরুদ্ধেই নয়, জাতীয় দলেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে ফিরে এসেছেন আচেরবি।

প্রায় দুই বছর দলে না থাকলেও কোচ স্পালেত্তি অবশেষে তাকে নরওয়ে ও মলদোভার বিপক্ষে স্কোয়াডে ডেকেছেন, যা তার অদম্য মনোবল এবং ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।