ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রমেই জটিল হচ্ছে ভোটের রাজনীতি। আগামী বছর ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সব রাজনৈতিক দল। ভোটের প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু করেছে বিএনপিও। মিত্রদের সঙ্গে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতা করার সম্ভাবনা বেশি বিএনপির।
এদিকে জামায়াতও ইসলামপন্থি দলগুলো নিয়ে বৃহৎ ‘নির্বাচনি ঐক্য’ গঠনের চেষ্টা করছে। তবে মতাদর্শিক দূরত্বের কারণে জামায়াতের সঙ্গে বড় ইসলামি দলগুলোর ঐক্য নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। সম্ভাবনা রয়েছে সবচেয়ে বড় ইসলামিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে থাকার সব ইসলামি দলগুলোর।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন দল এবং সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে দলটি। জোটে থাকতে পারে জামায়াতের ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিশ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু ইসলামি দলগুলো নয়, বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের মধ্যেও একটা ঐক্য তৈরি হতে পারে। আবার বিএনপির জোটে এনসিপিকেও দেখা যেতে পারে। জোট বা সমঝোতা নিয়ে পর্দার আড়ালে দলগুলোর নানা তৎপরতা চলছে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর সবকিছু দৃশ্যমান হবে।
এদিকে, ইসলামী আন্দোলনসহ ৫টি ইসলামি দল সমঝোতার পথে। এবি পার্টির সঙ্গে এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দলের হতে পারে ‘অ্যালায়েন্স’। মতাদর্শিক দূরত্বের কারণে জামায়াতের সঙ্গে বড় ইসলামি দলগুলোর ঐক্য না হলে এনসিপিসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গে হতে পারে ‘সমঝোতা’। একই সাথে, আগামী নির্বাচনের পর বিরোধী দল কে হবে- তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। তবে বিরোধী দল হওয়া নিয়ে নাটকীয় কিছু ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব তথ্য। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী এককভাবে বা বিএনপির বাইরে কোনো জোট গঠন করলেও ভোটের মাঠে সেভাবে সুবিধা নাও করতে পারে। সেক্ষেত্রে জামায়াত অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায়ও তাদের প্রার্থীদের জয়ী হতে বেগ পোহাতে হতে পারে।
দেশের স্বার্থে যেকোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্যে যেতে রাজি জামায়াত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জন-আকাক্সক্ষা পূরণ, দেশের স্বার্থে ও জাতীয় প্রয়োজনে যেকোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্যে যেতে রাজি জামায়াত। দেশের আদর্শ ও মূল্যবোধ যাতে কেউ ধ্বংস করতে না পারে, সে জন্য দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে অর্জিত সফলতা ধরে রখতে হলে ফ্যাসিবাদীদের বিচার ও সংস্কার ত্বরান্বিত করতে হবে। সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, নির্বাচন সামনে আসলে রাজনীতিতে অনেক মেরূকরণ হয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। আমরা চাই দেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম না হোক।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। আগামী নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টির জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, বিগত ৫৪ বছরে বিভিন্ন দলের শাসন দেখেছেন। সেখানে জনগণের কাক্সিক্ষত কল্যাণ সাধিত হয়নি। বিগত সরকারগুলো হত্যা, লুটপাট, দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের মাধ্যমে দেশকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। দেশের মানুষ এখন বলতে শুরু করেছে সব দলের শাসন দেখা হয়েছে, শুধু বাকি রয়েছে ইসলামি শাসন দেখার। তাই তো আমাদের আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের ডাক দিয়েছেন।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আলাপ-আলোচনা চলছে। অনেকে প্রার্থী ঠিক করেনি, নির্বাচনটা ঠিক কীভাবে হবে- অনেক বিষয় আছে। সময় গেলে তা আরও স্পষ্ট হবে।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা যে পথে অগ্রসর হচ্ছি তা হলো আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থি ভোট যাতে বিভক্ত না হয়। জোট নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। সমঝোতা-সমন্বয়টাও কীভাবে হবে- তা হয়তো আরও পরে প্রকাশ পাবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, সব ইসলামি দল, মত ও পথ যারা ইসলামের নামে কাজ করে সবাইকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। আগামী ২৫ জুন ৫টি রাজনৈতিক দল- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মসলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত মজলিসের বৈঠক হবে। এর আগেও আমরা বৈঠক করেছি।
জোটের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সদস্য সচিব আক্তার হোসেন বলেন, এনসিপি এখনো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে কাজ করে চলছে। নির্বাচনের জোট হবে কী হবে না তা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়নি। যদি বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচি মিলের কথাগুলোকে বিবেচনায় রেখে জোটের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছি না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপির নেতৃত্বে একটা জোট হবে সেটি অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি এবার সমমনা ইসলামি দল পৃথক জোট করবে। আবার যারা কর্তৃত্ববাদবিরোধী বামদল তাদেরও একটা জোট থাকবে। আরেকটা সমীকরণ হতে পারে। সেটি হলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল তাদের সঙ্গে পুরাতন কিছু দল মিলে জোট হবে। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গেও জামায়াত থাকতে পারে।
আবার এনসিপির সঙ্গেও জামায়াত থাকতে পারে। যদি এনসিপির সঙ্গে জামায়াত থাকে তাহলে ইসলামি দলগুলো এক সঙ্গে হয়ে যেতে পারে। তখন আবার জোটের সংখ্যা কমে যাবে। এমনও হতে পারে জামায়াত, এনসিপি এবং ইসলামি দলগুলো মিলে একটা জোট করে ফেলতে পারে। তবে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের পাল্লা যে ভারী হবে সেটি নিশ্চিত বলা যায়। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই নানা মেরূকরণ দেখা যাবে। বিগত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ‘ওয়ানম্যান শো’- এমন অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলও আছে, যাদের ভোটের আগে তৎপরতা বাড়বে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জোট ভারী করতে তাদেরও সঙ্গে রাখতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ওইসব দলের ভোটব্যাংক খুবই কম।
রাজনৈতিক বিভিন্ন সমীকরণ থেকে জানা যায়, দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি বিগত দিনে যেসব মিত্রদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, তাদের নিয়ে জোট করতে পারে। এ জোটে মুহাম্মাদ মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলও থাকতে পারে।
এ বিষয়ে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, মুহাম্মাদ মামুনুল হকের পরিবারের সঙ্গে জিয়া পরিবারের খুবই সুসম্পর্ক। তার বাবা প্রয়াত শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে ছিলেন। সেক্ষেত্রে সাত-আটটি ছাড়া বাকি ইসলামপন্থি দলগুলো একটি জোট করার চেষ্টা করতে পারে।
ইসলামপন্থি একটি রাজনৈতিক দলের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে অন্য কোনো ইসলামি দলের এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো জোট হয়েছে বলে দেখা যায়নি। এর কারণ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদির প্রতিষ্ঠা করা জামায়াতের সঙ্গে অন্যদের আকিদাগত মতপার্থক্য আছে, যা ইসলামি আন্দোলন ও কওমিভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শের বিপরীত। তারপরও রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। নানা মেরূকরণ ভোটের আগমুহূর্ত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তবে এখন পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো জোট গঠনের সম্ভাবনা নেই।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের বিগত নির্বাচনে ভোটের ইতিহাস দেখলে দোদুল্যমান ভোটারদের বেশির ভাগ ভোট পড়েছে ‘ধানের শীষ’ ও ‘নৌকা’ প্রতীকে। যেহেতু আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে নেই, তাই ধারণা করা হচ্ছে এসব ভোট ধানের শীষে যাবে, অথবা আওয়ামী লীগপন্থি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে সে পাবে। এখানে ইসলামপন্থি দলগুলোর বাক্সে দোদুল্যমান ভোট ততটা যাওয়ার রেকর্ড নেই। কারণ তাদের ভোট অনেকটা ‘ফিক্সড’। সে কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দল নিয়ে নাটকীয় কিছু ঘটতে পারে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ সারাক্ষণ রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করে। এসব বিবেচনায় তপশিল-পরবর্তী পরিস্থিতি অনুমান করলে এটিই প্রতীয়মান হবে যে, ওই সময় সমাজে আওয়ামী ঘরানার ইমেজসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করানো হতে পারে। বাস্তবে এরাই হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এর ফলে কিছু এলাকায় ভোটের রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে যেতে পারে। আর ভোট যেহেতু অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে, সেহেতু কম ভোটের ব্যবধানে নাটকীয় জয়-পরাজয় ঘটতে পারে।
গত কয়েক মাসে জোট ইস্যুতে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক: দীর্ঘ আদর্শিক বিরোধ থাকলেও ২১ জানুয়ারি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সাক্ষাৎ হয়। এর পাঁচ দিন পর চরমোনাই পীরের সঙ্গে দেখা করতে ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ ১০ দফায় একমত হয়ে ঘোষণাপত্রে সই করে দল দুটি। ২২ জানুয়ারি খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি।
তবে আগস্টে খেলাফত মজলিসসহ অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দল বৈঠক করে জামায়াতের সঙ্গে। গত ২৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফতের সম্মেলনে যোগ দিয়ে জামায়াতের আমির বলেছিলেন, ইসলামি দলগুলোর মাথায় আর কেউ কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে না। ১২ দলীয় জোট, সমমনা দলের সঙ্গে নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এখন অবশ্য প্রায় সব ইস্যুতে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তারা।
৫ এপ্রিল হেফাজত নেতারা বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই খেলাফত মজলিস, জমিয়ত ও নেজামে ইসলামের নেতারা হেফাজতেরও জ্যেষ্ঠ নেতা। বৈঠকের পর বিএনপির তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য ঐকমত্য হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া হেফাজতের একাধিক নেতা একই ভাষ্য জানালেও সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী পরদিন জানান, নির্বাচন নিয়ে কথা হয়নি। ৯ এপ্রিল এনসিপি কার্যালয়ে বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা। সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং জুলাই গণহত্যার বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতির দাবির সঙ্গে ঐকমত্য জানায় হেফাজত। ২০ এপ্রিল আবদুল বাসিত আযাদের নেতৃত্বাধীন খেলাফতের সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপি।
এদিকে, আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেনি হেফাজত। তাই গত কয়েক মাসে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট দলগুলোও জামায়াত থেকে দূরে সরে গেছে। যদিও ৫ আগস্টের পর কাছাকাছি এসেছিল।