ঢাকা বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

প্রাণহীন ফিল্টার কারখানা

হীরেশ ভট্টাচার্য হিরো, মাধবপুর (হবিগঞ্জ) 
প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২৫, ০৭:১৩ এএম
হবিগঞ্জের মাধবপুরে ফিল্টার কারখানায় ব্যস্ত এক নারী শ্রমিক। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

হবিগঞ্জের মাধবপুর, একসময় যেখান থেকে ট্রাকভর্তি পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছিল ‘মাধবপুরের ফিল্টার’। সিমেন্ট, বালি, মোজাইক আর নিজস্ব কৌশলে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি করা সেই ফিল্টার ছিল টেকসই, প্রাকৃতিকভাবে পানি ঠাণ্ডা রাখার সক্ষমতায় অনন্য এবং চাহিদায় তুঙ্গে।

তবে সময়ের পরিবর্তনে, প্রযুক্তির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় সেই গৌরব আজ শুধুই স্মৃতি। এখন মাধবপুরের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প টিকে আছে শুধু কিছু কারিগরের শেষ চেষ্টা আর পৈতৃক পেশার প্রতি আবেগের ওপর ভর করে।

মাধবপুর পৌর শহরের কাছারিপাড়ার ফিল্টার কারিগর বাবুল মালাকারের স্ত্রী বলেন, ‘আগে সারা বছর ফিল্টার তৈরিতে ব্যস্ত থাকতাম। এখন প্লাস্টিকের নানান ডিজাইনের দেশি-বিদেশি ফিল্টার বাজারে সহজে পাওয়া যাচ্ছে। দামেও কম, আকর্ষণেও বেশি। আমাদের তৈরি সিমেন্ট-মোজাইক ফিল্টার তাই আর আগের মতো বিক্রি হয় না।’

ফিল্টার কারখানার মালিক মো. খলিল মিয়ার অভিমত, ‘চুনাপাথর, সিমেন্ট, মোজাইকসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। একেকটা ফিল্টার তৈরিতে অনেক খরচ পড়ে, অথচ একই সাইজের প্লাস্টিক ফিল্টার আধা দামে পাওয়া যায়। মানুষ তো সস্তা জিনিসের দিকেই ঝুঁকবে।’

বর্তমানে শুধু সিলেট বিভাগের কিছু জায়গা এবং ফরিদপুর জেলায় মাধবপুরের ফিল্টারের সামান্য চাহিদা রয়ে গেছে। সেই চাহিদা পূরণে যারা এখনো কাজ করছেন, তাদের জন্য এটি মূল পেশা নয়। বরং পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।

লিটন বিশ্বাস নামের এক কারখানা মালিক জানান, ‘মাধবপুরে এখনো প্রায় ১৭টি ফিল্টার কারখানায় প্রায় ২০০ শ্রমিক কাজ করছে। প্রতি মাসে কারখানাভেদে ২০০ থেকে ৩০০টি ফিল্টার তৈরি হয়। কিন্তু লাভ বলতে কিছুই নেই। শুধু ভালোবাসা আর পুরনো সম্পর্কের খাতিরে কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি।’

সব কারিগর ও কারখানা মালিকের বক্তব্য একটাই, এই পেশায় টিকে থাকা এখন অসম্ভব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চাহিদার হ্রাস আর আধুনিক প্রতিযোগিতার বাজারে তারা নিজেদের অসহায় মনে করছেন।

তাদের সবার দাবি, ‘সরকারি সহায়তা কিংবা প্রণোদনা না পেলে অচিরেই এই শিল্প পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের তৈরি ফিল্টারের পরিবেশবান্ধব দিকটি বিবেচনা করে হলেও এ শিল্পকে বাঁচানো দরকার।’

মাধবপুরের ফিল্টার ছিল একসময়ের গর্ব। এখন সেটি হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। যদি সময়মতো সহায়তা না মেলে, তবে শিগগিরই হারিয়ে যাবে এক ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, যা কেবল পেশা ছিল না, ছিল একটি অঞ্চলের পরিচিতি ও গর্বের প্রতীক।