ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫

ইরানে হামলার পরিকল্পনায় ‘সায়’ দিলেও অনুমতি ‘দেননি’ ট্রাম্প

আরিয়ান স্ট্যালিন
প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২৫, ১২:০৯ এএম
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইনসেটে বি-২ বোম্বার যুদ্ধবিমান। ছবি- সংগৃহীত

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি দিনদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দুই দেশই একে-অপরকে লক্ষ্য করে শত শত মিসাইল ছোড়ার পাশাপাশি নিয়মিত ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সামরিক হামলার পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছেন, তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছে বিবিসির সহযোগী সংস্থা সিবিএস।

সিবিএস জানিয়েছে, এক শীর্ষ গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে ট্রাম্প হামলা শুরু থেকে বিরত ছিলেন, সম্ভাব্য কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ রাখতে; বিশেষ করে যদি ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে রাজি হয়। ট্রাম্পের নজর এখন ইরানের ফোর্দো অঞ্চলে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে হামলার দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন; তবে দেশটিতে হামলা চালানো হবে কি না তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি বলে খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।

শীর্ষ এক গোয়েন্দার বরাতে সিবিএস লিখেছে, ইরানকে তার পরমাণু কর্মসূচি থেকে সরে আসার সুযোগ দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আপাতত হামলা থেকে বিরত রয়েছেন। ফরদোতে ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে ট্রাম্প হামলার কথা বিবেচনা করছেন বলে খবর এসেছে। নিজের ‘ধৈর্যের সীমা’ ফুরিয়ে এসেছে জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শর্তহীন আত্মসমর্পণের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।

ইরানে সম্ভাব্য হামলার প্রশ্নে ট্রাম্প বুধবার বলেছিলেন, ‘আমি করতেও পারি, নাও পারি।’ সেদিনই ট্রাম্পকে ভর্ৎসনা করে ভিডিওবার্তায় খামেনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপের চড়া মূল্য গুনতে হবে।’ তিনি এও বলেন, ‘ইরানি জাতি কখনো আত্মসমর্পণ করে না।’

খামেনির এই প্রত্যাখ্যানকে তাচ্ছিল্য করে ট্রাম্প বলেন, ‘শুভ কামনা।’ তবে তিনি নিজের পরিকল্পনা প্রকাশ করেননি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি কী করতে যাচ্ছি তা কেউই জানে না।’ আর নিতে পারছেন না মন্তব্য করে তিনি ‘শর্তহীন আত্মসমর্পণের’ আহ্বান জানান। ট্রাম্পের হামলার পরিকল্পনা অনুমোদনের খবর প্রথম প্রকাশ করে ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’।

বিবিসি লিখেছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। তার জবাবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা জানিয়েছে ইরান। তবে ইসরায়েলে গুরুতর কোনো ক্ষতির খবর শোনা যায়নি। ইসরায়েল শুক্রবার হামলা শুরু করার পর প্রথমবারের মতো বুধবার খামেনির বক্তব্য এসেছে।

ট্রাম্পকে উপহাস করে জাতিসংঘে ইরানের মিশন এক্স পোস্টে লিখেছে, ‘ইরান কখনো চাপের মুখে আলোচনা করে না, শান্তি গ্রহণ করে না এবং নিশ্চিতভাবেই এমন এক যুদ্ধবাজের সঙ্গে নয় যে কিনা প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।’ এতে বলা হয়, ‘কোনো ইরানি কর্মকর্তা কখনও হোয়াইট হাউজের গেইটে গিয়ে মাথা নত করার আবেদন জানায়নি।’ “তার মিথ্যাচারের চেয়েও বেশি ঘৃণ্য হলো ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ‘খতম’ করার তার কাপুরুষোচিত হুমকি।”

ইসরায়েলের সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়েছিল আরব দেশগুলো- অর্থাৎ সিরিয়া, মিসর ও জর্ডান। সেটা ঘটেছিল ১৯৬৭ সালের জুনে। ঠিক ৫৮ বছর পরের জুনে যেন সেই ‘কলঙ্ক’ মুছল ইরান। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে চলমান ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ সপ্তম দিনে গড়িয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলোর সহায়তায় গত প্রায় ছয় দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা ইসরায়েল ক্রমাগত আঘাত করেও সামরিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইরানকে ‘ধরাশায়ী’ করতে পারেনি।

অন্যদিকে ইসরায়েলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। গতকাল ইসরায়েলে আবারও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এ হামলার ফলে জনগণকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেছে ইসরায়েল। গতকাল আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সামাজিক যোগাযাগমাধ্যম এক্সের এক পোস্টে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সম্প্রতি ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইরানের এ হামলা ঠেকাতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজ করছে। পোস্টে বলা হয়েছে, ইসরায়েল বাসিন্দাদের নিরাপদ এলাকায় চলে যেতে নির্দেশনা দিয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের সেখানে থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে ‘সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতির’ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তুরস্ক। এ ছাড়া তুরস্ক ইরানের সঙ্গে সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়িয়েছে দেশটি। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি গোপন সূত্রের বরাতে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের আরাক শহরে ভারী পানির (ডিউটেরিয়াম অক্সাইড মিশ্রিত) পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার এ দাবি করেছে বলে এক প্রতিবদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ইরান থেকে আরও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সামাজিক মাধ্যম এক্সের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কাজ করছে। তাই সেনাবাহিনী দেশটির জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলেছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকতে বলা হয়েছে। 

সংঘাত শুরুর পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ইরানে অন্তত ৬৩৯ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস। সংঘাত এরই মধ্যে সপ্তম দিনে পৌঁছেছে।  বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা। সংবাদমাধ্যমটির লাইভে বলা হয়, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে ২৬৩ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ১৫৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৩২০ জন। ইরানের সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইসরায়েলে ১৩৭ জন আহত হয়েছে।

ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যমের বরাত দিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে এই দাবি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান সর্বশেষ ইসরায়েলের যেসব জায়গায় হামলা চালিয়েছে সেগুলো থেকে ১৩৭ জনকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এদিকে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা ‘মাগেন ডেভিড অ্যাডম’ বলেছে, ইরানের হামলায় বৃহস্পতিবার ইসরায়েলে ৮৯ জন আহত হয়েছে। তেল আবিব ও ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলায় তারা আহত হন। 

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। আজ শুক্রবার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ইসরায়েল এই বৈঠকে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন। ইরান, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও আলজেরিয়ার অনুরোধে এ বৈঠক হবে। চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজ। নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরায়েল অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন। খবর বিবিসির। সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা বলছে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ শুক্রবার নিউইয়র্ক সময় সকাল ১০টায় জরুরি বৈঠকে বসতে চলেছে। 

ইসরায়েলের আগ্রাসনে ভয় না পেয়ে অটল থাকতে নিজ দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। এক্স হ্যান্ডলে দেওয়া এক পোস্টে এই আহ্বান জানান খামেনি। তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, শত্রু যদি বুঝতে পারে আপনি তাদের ভয় পাচ্ছেন, তাহলে তারা আপনাকে ছাড়বে না। তিনি আরও বলেন, আপনারা এখন পর্যন্ত যেভাবে আচরণ করেছেন, তা অব্যাহত রাখুন; সেই আচরণই আরও দৃঢ়তার সঙ্গে চালিয়ে যান।

এদিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সরকার ও প্রশাসনের সব বিভাগকে ইরানের জনগণের পাশে থাকতে বলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এই আহ্বান জানান। বুধবার (১৮ জুন) রাতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আপস নয়’, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির এমন ঘোষণায় উল্লাসে ফেটে পড়েন দেশের নাগরিকরা। ইরানের জাতীয় পতাকা হাতে তেহরানের সড়কে হয় বিশাল শোডাউন।

বুধবার (১৮ জুন) রাতে রাজধানী তেহরানসহ অন্যান্য স্থানে গাড়িবহর নিয়ে বের হয় উচ্ছ্বসিত ইরানিরা। মোটরসাইকেল, পিকআপ কিংবা গাড়িতে চড়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করেন তারা। আনন্দ-স্লোগানে মুখরিত হয় পুরো রাজপথ। কোনো দেশের কাছে আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। সর্বোচ্চ নেতার ঘোষণায় পুরো ইরানে নেমে এসেছে গণজোয়ার। জাতীয়তাবাদী চেতনায় যেন নতুন করে জেগে উঠেছে ইরানিরা। এ অবস্থায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। বৃহস্পতিবার  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া বার্তায় সরকার ও প্রশাসনের সব বিভাগকে ইরানের জনগণের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থাকে সর্বোচ্চ শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। কোনো কিছুর প্রতি বিমুখ না হয়ে ধৈর্যের সঙ্গে জনগণকে সেবা দিয়ে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, আশা করি একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ঐক্যের মাধ্যমে আমরা এই কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে পারব। এদিকে রানের পাল্টা সামরিক অভিযানে ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়।

দেশটির শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইদিয়োথ আহারোনোথ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলমান সংঘাতের কারণে ইসরায়েলের ৫ হাজার ১১০ জন নাগরিক গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী তেল আবিব শহর থেকেই গৃহহীন হয়েছেন ৯০৭ জন। খবর আলজাজিরা। ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি ইরানের দিক থেকে চালানো মিসাইল ও ড্রোন হামলার ফলে একাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকায়, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।