বামপন্থিদের কাছে এক কিংবদন্তি ও গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে ‘পেপে’ মুজিকা আর নেই। তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। খাদ্যনালির ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ এক বছরের লড়াইয়ের পর চলতি মে মাসের শুরুতে তাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল।
উরুগুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইয়ামান্দু ওরসি এক্স হ্যান্ডলে এক শোকবার্তায় বলেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা আমাদের কমরেড পেপে মুজিকার প্রয়াণের খবর জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক কর্মী, পথপ্রদর্শক এবং নেতা। প্রিয় বন্ধু, আপনাকে আমরা খুব মিস করব।’
বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস শোকবার্তায় তার অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে স্মরণ করেন।
ব্রাজিল সরকার তাকে ‘আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে শোক প্রকাশ করেছে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, ‘মুজিকা একটি উন্নত বিশ্বের জন্য বেঁচে ছিলেন।’
গুয়াতেমালার বার্নার্ডো আরেভালো তাকে ‘নম্রতা এবং মহত্বের উদাহরণ’ হিসেবে তুলে ধরেছেন শোকবার্তায়।
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী গেরিলা গোষ্ঠী ‘তুপামারোস’ থেকে মূলধারার রাজনীতিতে মুজিকার যাত্রা লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার জনপ্রিয়তার মূলে তাঁর সরল দার্শনিক চিন্তাভাবনা। ১৯৭২-৮৫ সালে উরুগুয়ের স্বৈরশাসনের সময় মুজিকা ১৩ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। এর অর্ধেকেরও বেশি সময় তিনি একটি ছোট্ট সেলে বন্দি ছিলেন। মাসে মাত্র কয়েকবার ব্যায়াম করার জন্য তাঁকে বাইরে বের হতে দেওয়া হতো।
সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেখানে কোনো বই বা অন্য কোনো সঙ্গ ছিল না, সেই স্মৃতি রোমন্থন করে মুজিকা বলেছিলেন, তিনি সেখানে চিন্তা করতে শিখেছিলেন।
মুক্তির পর স্প্যানিশ সংবাদপত্র এল পাইসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুজিকা বলেন, ‘নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য আমি আমার পড়া জিনিসগুলো এবং যৌবনে আমার চিন্তাভাবনাগুলো স্মরণ করতে শুরু করি। পরে আমি বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করি এবং আর কিছুই পড়িনি। আমি বিশ্বকে বদলাতে পারিনি, কিন্তু যৌবনে যা পড়েছিলাম, তা আমাকে সাহায্য করেছিল।’
২০০০ সালে সিনেটর হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশের পর উরুগুয়ের প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট তাবারে ভাজকুয়েজের অধীনে পশুপালন মন্ত্রী হন মুজিকা। ২০০৯ সালের নভেম্বরে তিনি ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০১০-১৫ সালের মেয়াদে মুজিকা তার বেতনের বেশির ভাগ অংশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে খ্যাতি পান। তিনি স্যান্ডেল পরে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে তার ছোট্ট খামারে বসবাস করতেন। বাড়িতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলতে ছিল ১৯৮৭ সালের একটি ফক্সওয়াগন বিটল গাড়ি।
২০২০ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তার সেই ‘চাকরা’ বা ক্ষুদ্র খামার বামপন্থি রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং অনুরাগীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। মুজিকা ভোগবাদের সংস্কৃতি এবং এর ফলে পৃথিবীর পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তার কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমরা আত্মঘাতী সমাজ তৈরি করেছি। আপনার কাজ করার সময় আছে, কিন্তু বাঁচার সময় নেই।’
২০২৪ সালের মে মাসে মুজিকার ক্যানসার ধরা পড়ে। মুজিকার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি বেঁচে আছেন। গেরিলা যোদ্ধা থাকার সময় লুসিয়ার সঙ্গে মুজিকার পরিচয়। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই।
মৃত্যুর আগে তিনি সেই খামারে, তার পোষা কুকুরের পাশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন।