ইরান-‘ইসরায়েল’ যুদ্ধ বিশ্বকে বিভক্ত করে তুলেছিল। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইহুদিবাদী দখলদার রাষ্ট্রের ইরানের ওপর আক্রমণ করার অধিকার রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার রয়েছে। উভয় দেশ যখন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, বোমা ফেলেছিল এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছিল, তখন ভাইরাল হয়েছে ইহুদিবাদ-বিরোধী একটি গান।
ইরানের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম আইআরএনএ-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ‘বুম বুম তেল আবিব’ শিরোনামের গানটি গত ২০ জুন মুক্তি পায়। এরপর থেকে ইরানি ও রাশিয়ান সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোতে ব্যাপক প্রচার হয়েছে। এবং তাৎক্ষণিকভাবে ইনস্টাগ্রাম, এক্স ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভাইরাল হয়ে গেছে। মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ৫৭৭ মিলিয়ন ভিউ হয়েছে।
পার্স টুডে জানিয়েছে, গানের কথা ও বিষয়বস্তু দর্শকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। এতে ইসরায়েলের প্রতারণা, নিরীহ মানুষের ওপর হামলা এবং গাজায় চালানো বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা তুলে ধরা হয়েছে। ‘ইসরায়েলে’র কট্টরপন্থী শাসকগোষ্ঠীর অপরাধ ও তেল আবিবে বোমা হামলার বিষয়ে ইরানের প্রতিক্রিয়ার পর প্রকাশিত হয়েছে এই গান।
গত ২৫ জুন তেহরান টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘অডিও ওয়ারহেড: বুম বুম তেল আবিব’ শিরোনামে গানটির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় গানটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এক ব্যবহারকারী লেখেন, “‘বুম বুম তেল আবিব’ শুধু একটি গান নয়, এটি অন্যায়ের শিকার মানুষের কণ্ঠস্বর। এর কথা হৃদয়ছোঁয়া, সুর আবেগময় এবং বার্তা স্পষ্ট।” এই গান এখন শুধু একটি সংগীত নয় বরং এটি একটি প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
যদিও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে ‘বুম বুম তেল আবিব’ গানটি সরিয়ে ফেলেছে, তবুও অনেক ব্যবহারকারী এটি আবার পোস্ট করেছেন। তারা এই গানকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দেখছেন। গানটির ভিডিওতে তেল আবিবের ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানতে দেখা যায়, যেখানে ভবনগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এই গান শুধু অনলাইনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাস্তব ঘটনাতেও এর উপস্থিতি দেখা গেছে। ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত এক ইরানি সামরিক কর্মকর্তার শেষকৃত্যে ‘বুম বুম তেল আবিব’ লেখা একটি ব্যানার প্রদর্শিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
‘বুম বুম তেল আবিব’ গানের গায়ক ও প্রযোজক লুকাস গেজ নিজেকে একজন সাবেক মার্কিন সেনা ও ফিলিস্তিনপন্থী হিসেবে পরিচয় দেন। তার ভাষ্য মতে, এটি ইসরায়েলের ‘রক্তপাতের ফল’। তিনি বলেন, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যেন তোমার আকাশে আলো ছড়ায়, আর তুমি বলছ তুমি যুদ্ধ শুরু করোনি, কিন্তু পুরো বিশ্ব জানে তুমি মিথ্যা বলছ।’
আমেরিকান-ইতালীয় নাগরিক গেজ আরও বলেন, ‘ইরান কখনও আমাদের প্রেসিডেন্টদের হত্যা করেনি। ইরান কখনও আমাদের কর্মীদের ধ্বংস করেনি। ইরান কখনও আমাদের প্রযুক্তি চীনের কাছে বিক্রি করেনি। ইরান কখনও আমাদের ভবন উড়িয়ে দেয়নি। ইরান কখনোই আমাদের যুদ্ধে নামার জন্য প্রতারণা করেনি, কিন্তু ইসরায়েল এই কাজগুলো করেছে।’
গেজের আলোড়ন সৃষ্টি করা অন্যান্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘ডেথ টু দ্য আইডিএফ’, ‘ডব্লিউডব্লিউআইআইআই’ এবং ‘কেনেডি কিলারস’। চলতি বছরের গ্লাস্টনবারি সঙ্গীত উৎসবে ইসরায়েল-বিরোধী স্লোগানে আরেক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় পাঙ্ক সংগীতজুটি বব ভাইলান মঞ্চ থেকে ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন’ এবং ‘ডেথ টু দ্য আইডিএফ’ বলে স্লোগান দেয়। বিট্রিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিরুদ্ধে অনুষ্ঠানটির ফুটেজ সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
তবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার প্রকাশ্য অবস্থানের কারণে তিনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অনেক সমালোচক গেজকে একজন উগ্র ও চরমপন্থি হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ তাকে ‘নব্য-নাৎসি’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
সাংবাদিক ড্যান কোহেন গত অক্টোবরে এক মন্তব্যে বলেন, ‘গেজ নিজেকে ফিলিস্তিনের সমর্থক হিসেবে তুলে ধরেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি একজন নাৎসি মতাদর্শে বিশ্বাসী। তিনি প্রকাশ্যে ইহুদিদের ঘৃণা করেন, হিটলারের প্রশংসা করেন এবং ইহুদিবিদ্বেষকে অন্য ইস্যুর সঙ্গে মিশিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে চান।’
গানের কথাগুলো কী
‘তুমি যখন ফিলিস্তিনের মৃত শিশুদের নিয়ে উপহাস করছিলে, তখন ভাবোনি একদিন এর ফলভোগ করতে হবে। এখন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রে তোমার আকাশ আলোকিত, আর তুমি কাঁপছ আতঙ্কে, যেমনটা ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন অনুভব করে। তুমি বলছো তুমি যুদ্ধ শুরু করোনি, কিন্তু পুরো বিশ্ব দেখছে, কে শুরু করেছিলো আর কে মিথ্যা বলছে।’
‘তোমার যেসব খারাপ কাজ, নিরীহ মানুষকে হত্যা, শিশুদের উপর বোমা বর্ষণ, তারই আজ প্রতিফলন দেখছ। তুমি চাইলেই এসব এড়াতে পারতে। কিন্তু মানবতা কখনও তোমার কাছ থেকে মানবিক আচরণ আশা করেনি। তাই আজকের এই জবাব তোমারই কর্মফল।’
আপনার মতামত লিখুন :