মিশরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পরোক্ষ আলোচনায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্দি বিনিময়ের ইস্যু। দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি আলোচনায় এটি অন্যতম বিতর্কিত ও সংবেদনশীল বিষয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি; দুই পক্ষের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি বা সমঝোতা চুক্তির আলোচনায় ‘বন্দি বিনিময়ের ফাইল’ই হয়ে উঠেছে মূল আলোচ্য বিষয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত মধ্যস্থতা পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজায় আটক ৪৭ জন ইসরায়েলি বন্দির বিনিময়ে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে ২৫ জন ইসরায়েলি নাগরিকের মরদেহও অন্তর্ভুক্ত। তবে হামাসের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, যেকোনো চুক্তিতে ইসরায়েলের কারাগারে বহু বছর ধরে আটক কয়েকজন বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি নেতার মুক্তি থাকতে হবে।
এই দাবিই এখন আলোচনার সবচেয়ে বড় বাধা।
হামাসের তালিকার শীর্ষে মারওয়ান বারঘৌতি
ফিলিস্তিনি রাজনীতির সবচেয়ে প্রতীকী বন্দিদের মধ্যে অন্যতম মারওয়ান বারঘৌতি। ফাতাহ দলের এই সিনিয়র নেতা বহু ফিলিস্তিনির কাছে ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচিত। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হন ফিলিস্তিনি আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে।
২০০২ সালে ইসরায়েলের ‘অপারেশন ডিফেন্সিভ শিল্ড’ অভিযানের সময় গ্রেপ্তার হন বারঘৌতি। ইসরায়েলি আদালত তাকে ইসরায়েলি নাগরিক হত্যার দায়ে পাঁচটি যাবজ্জীবন এবং ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘বারঘৌতি সন্ত্রাসবাদের প্রতীক। তাকে মুক্তি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
‘হামাসের প্রকৌশলী’ আবদুল্লাহ বারঘৌতি
হামাসের আরেক প্রভাবশালী বন্দি আবদুল্লাহ বারঘৌতি। তিনি ‘হামাসের প্রকৌশলী’ হিসেবেই পরিচিত। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হিসেবে ২০০১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ইসরায়েলে একাধিক বড় বোমা হামলার নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে ৬৭টি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন, যা ইসরায়েলি আদালতের দেওয়া সবচেয়ে দীর্ঘ কারাদণ্ডগুলোর একটি।
মারওয়ান বারঘৌতির চাচাতো ভাই আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে জেরুজালেমের সাব্বারো রেস্তোরাঁ, ক্যাফে মোমেন্ট এবং হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে, যেখানে পাঁচজন মার্কিন নাগরিকসহ ৬৬ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিলেন। ইসরায়েলি গণমাধ্যম তাকে একসময় ‘ইয়াহিয়া আয়াশের উত্তরসূরি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।
ইসরায়েলের সবচেয় ‘বিপজ্জনক বন্দি’ ইব্রাহিম হামেদ
ইব্রাহিম হামেদকে ইসরায়েল তাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দিদের একজন বলে মনে করে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় তিনি পশ্চিম তীরে হামাসের সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন। ২০০৬ সালে আত্মগোপন থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ৪৬ জন ইসরায়েলির মৃত্যুর ঘটনায় হামলা পরিচালনার অভিযোগে ৫৪টি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী হামেদ কারাগারে থাকাকালীন ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। আট বছর তিনি একাকী কারাবাসে কাটিয়েছেন, যার মধ্যে টানা সাত বছর নির্জন সেলে ছিলেন।
আহমেদ সা’আদাত: পিএফএলপির বামপন্থী প্রতীক
আলোচনায় বারবার উঠে আসছে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের (পিএফএলপি) মহাসচিব আহমেদ সা’আদাতের নামও। ২০০৬ সালে রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তরে ইসরায়েলি অভিযান চলাকালে গ্রেপ্তার হন তিনি। ২০০১ সালে ইসরায়েলি পর্যটনমন্ত্রী রেহাভাম জিভিকে হত্যার অভিযোগে ৩০ বছরের কারাদণ্ড পান সা’আদাত।
৭০-এর কোঠায় পা দেওয়া এই নেতা ১৯৭৬ সাল থেকে একাধিকবার কারাভোগ করেছেন। কারাবন্দি অবস্থায় তিনি লিখেছেন ‘ইকো অব দ্য চেইনস’ নামের বই, যেখানে ইসরায়েলের নির্জন কারাবাস নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি চার সন্তানের পিতা এবং দাদা।
আব্বাস আল-সাইয়িদ ও হাসান সালামেহ
হামাসের তালিকায় আরও আছেন আব্বাস আল-সাইয়িদ। তিনি ২০০২ সালে নেতানিয়ার পার্ক হোটেল বোমা হামলার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হন। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ওই হামলাটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, যাতে বহু ইসরায়েলি নিহত হয়।
অন্যদিকে, হামাসের সশস্ত্র শাখার সিনিয়র কমান্ডার হাসান সালামেহও রয়েছেন আলোচিত তালিকায়। তিনি ৪৬টি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন, একাধিক আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে।
কৌশলগত গুরুত্ব
রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক কমান্ডার মিলে এই ছয়জন বন্দি প্রতিবারই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছেন। হামাসের দৃষ্টিতে তাদের মুক্তি হবে এক বিশাল কৌশলগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। তবে ইসরায়েলের জন্য তারা ‘লাল রেখা’র প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের মুক্তি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মনে করে দেশটির সরকার ও সামরিক গোয়েন্দা মহল।
চূড়ান্ত চুক্তির নির্ধারক
মিশরের আলোচনার পরবর্তী ধাপ এখন এই বন্দিদের ভাগ্য নির্ধারণের ওপরই নির্ভর করছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি হামাস এই দাবিতে অনড় থাকে এবং ইসরায়েল তার নিরাপত্তা সীমা ছাড়তে না চায়, তবে পুরো বন্দি বিনিময় ও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাই আবারও ভেঙে পড়তে পারে।
একজন মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞের ভাষায়, ‘এই ছয়জন বন্দি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারাগারের কয়েদি নন; তারা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের ইতিহাসের প্রতীক। কিন্তু একইসঙ্গে তারা ইসরায়েলের নিরাপত্তা-রাজনীতির সবচেয়ে সংবেদনশীল দিকও।’
মিশরে হওয়া আলোচনা এখন এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ইতিহাস, রাজনীতি ও মানবিক বিবেচনা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত। এই ভারসাম্যই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে সমঝোতার দরজা খুলবে, নাকি আবারও বন্ধ হয়ে যাবে।