ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই, ২০২৫

‘একে-৪৭’ ইতিহাসের জনপ্রিয় ও বিতর্কিত অস্ত্র কেন?

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২৫, ০৯:০৩ পিএম
‘একে-৪৭’, বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত অস্ত্র। ছবি- সংগৃহীত

বিশ্বের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত, আলোচিত ও প্রাণঘাতী অস্ত্র-‘একে-৪৭’। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র, গেরিলা লড়াই কিংবা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ- সব ক্ষেত্রেই এই আগ্নেয়াস্ত্রের উপস্থিতি চোখে পড়ে। কল্পনার তুলনায় বাস্তবে এর ক্ষমতা অনেক বেশি।

বিশ্বের অন্তত ১০৬টি দেশের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী এখনো একে-৪৭ ব্যবহার করে। এমনকি এটি এতটাই কার্যকর যে কাদা, ধুলা, বৃষ্টি, বরফ, পানির নিচে কিংবা আগুনের মধ্যেও এটি কার্যকরভাবে গুলি ছুড়তে সক্ষম।

সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন উপলব্ধি করে- তাদের প্রচলিত রাইফেলগুলো ধীরগতির এবং অকার্যকর। আবার সাব-মেশিনগান দিয়ে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা কঠিন। এ কারণে তারা এমন একটি অস্ত্রের খোঁজ করে যা হবে- সহজে ব্যবহারযোগ্য, নির্ভরযোগ্য, স্বয়ংক্রিয় এবং কার্যকর।

এই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার তরুণ সেনা সদস্য ‘মিখাইল কালাশনিকভ’ এগিয়ে আসেন। তিনি ছিলেন ট্যাংকের সার্জেন্ট। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার ভিত্তিতে তিনি নকশা করেন একটি আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের।

তিনি কোনো অস্ত্র প্রকৌশলী ছিলেন না, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে চালিত করেছিল। সাত বছরের পরিশ্রমে তৈরি করেন একে-৪৭, যা ১৯৪৭ সালে প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়।

‘একে-৪৭’ নামের অর্থ

এর পুরো নাম- আভতোমাত কালাশনিকোভা ১৯৪৭। ‘আভতোমাত ’ অর্থ- স্বয়ংক্রিয়, আর ‘কালাশনিকোভা’ হলো উদ্ভাবকের নাম। ১৯৪৭ সালে  রাইফেলটির নকশা তৈরি।

বিশ্বজুড়ে একে-৪৭

উৎপাদন খরচ কম, ব্যবহারে সহজ, সহজে খোলা–জোড়া লাগানো যায়, কম রক্ষণাবেক্ষণ লাগে, এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এটি দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

এই অস্ত্রটি শুধু সশস্ত্র বাহিনীতে নয়, বিপ্লবী গোষ্ঠী, গেরিলা বাহিনী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, এমনকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরও পছন্দের অস্ত্র।

বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটিরও বেশি একে-৪৭ বা এর সংস্করণ তৈরি হয়েছে। অনেক দেশে এটি অননুমোদিতভাবে তৈরি হয়। আফগানিস্তান, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা- প্রত্যেকটি অঞ্চলের যুদ্ধ ও সংঘর্ষে একে-৪৭ ছিল একটি সাধারণ চিত্র।

বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠা অস্ত্র

একে-৪৭ এমন একটি অস্ত্র যা শুধু যুদ্ধ নয়, রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। মোজাম্বিকের জাতীয় পতাকায় রয়েছে একে-৪৭-এর ছবি, বহু বিপ্লবী পোস্টারে, ব্যানারে এটি দেখা যায়, ছাড়াও কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামে একে-৪৭ যেন এক ধরনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উদ্ভাবকের উপলব্ধি

মিখাইল কালাশনিকভ জীবদ্দশায় নিজের আবিষ্কারের জন্য অনেক প্রশংসা পেলেও, বার্ধক্যে এসে তার মধ্যে অনুশোচনাও দেখা দেয়। ২০০৭ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখন দেখি, আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়, তখন আমার খুব কষ্ট হয়। আমার রাইফেল সৈন্যদের জন্য ছিল, সন্ত্রাসীদের জন্য নয়।’

২০১৩ সালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান কালাশনিকভ। মৃত্যুর আগে এক খোলা চিঠিতে তিনি রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চের প্রধানের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন- ‘আমি কি একজন খুনির সঙ্গে তুলনীয়, কারণ আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে লাখো মানুষ মারা গেছে?’