সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাইপ্রাসে ইসরায়েলি নাগরিক, বিশেষ করে সম্পদশালী ইহুদিদের আগমন এবং ব্যাপক জমি ও সম্পত্তি ক্রয় নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে এরই মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যেও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে বিষয়টি।
ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ইয়েদিওত আহারনোত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলিরা সাইপ্রাসে ব্যাপক হারে অ্যাপার্টমেন্ট ও জমি কিনছেন। এতে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব এবং সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি নাগরিকদের এ ভূমি ক্রয় কার্যক্রম কেবল বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে নয়; বরং এটি একটি সুসংগঠিত আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছেন অনেকেই। ইস্যুটি এখন সাইপ্রাসের রাজনীতি ও গণমাধ্যমে অন্যতম আলোচিত বিষয়।
সাম্প্রতিক এক সম্মেলনে সাইপ্রাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বামপন্থি আকেল পার্টির মহাসচিব স্টেফানোস স্টেফানো সতর্ক করে বলেন, ‘যেভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে ধাপে ধাপে জমি কিনে দখল প্রতিষ্ঠা করেছে, সাইপ্রাসেও এখন সেই একই পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে।’
স্টেফানো দাবি করেন, ‘এটি শুধু ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা—যার মধ্যে রয়েছে বসতি স্থাপন, ধর্মীয় স্কুল ও উপাসনালয় নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’
তিনি বলেন, ‘কৌশলগত এলাকাগুলোতে—যেমন সেনা ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর পার্শ্ববর্তী এলাকায়—ইচ্ছাকৃতভাবে জমি কেনা হচ্ছে, যা সাইপ্রাসের সার্বভৌমত্বের জন্য সরাসরি হুমকি।’
আকেল পার্টির আরও অভিযোগ, এসব জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে জায়নবাদী ধর্মীয় স্কুল, উপাসনালয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনার অংশ। তারা সাইপ্রাস সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের বিনিয়োগে অনিয়ন্ত্রিত ছাড় দেওয়ার অভিযোগ এনেছে এবং অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে সাইপ্রাসে আনুমানিক ২,৫০০ ইসরায়েলি নাগরিক স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে হতে পারে, যাদের অনেকেই ইউরোপীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে বসবাস করছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের ইহুদি উদ্বাস্তুদের জন্য সাইপ্রাস ছিল একটি প্রধান আশ্রয়স্থল। বর্তমানে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে পুনরায় হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক দ্বীপটিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এমনকি গুঞ্জন রয়েছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও সম্প্রতি কিছুদিন সাইপ্রাসে অবস্থান করেছেন।
সরকারি নথি অনুসারে, ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে লারনাকায় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি এবং লিমাসোলে ১ হাজার ১৫০টিরও বেশি সম্পত্তি কিনেছেন ইসরায়েলিরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব অঞ্চল ধীরে ধীরে ‘মিনি ইসরায়েল’-এ পরিণত হচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে আকেল পার্টি পার্লামেন্টে দুটি বিল উত্থাপন করেছে। একটি হলো ‘গোল্ডেন ভিসা’ নীতিমালার সংস্কার এবং অপরটি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের নাগরিকদের জমি কেনা ও বিনিয়োগের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ সংক্রান্ত। দলটি সতর্ক করেছে, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সাইপ্রাসের নিজস্ব ভূখণ্ড নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হতে পারে।
সাইপ্রাস মেইল–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক ইসরায়েলি নাগরিক এখন সাইপ্রাসকে তাদের ‘দ্বিতীয় ঘর’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ইরানের সঙ্গে বিরোধের কারণে সাইপ্রাসে এই ঢল আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চলে চলমান অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা ইহুদিবাদী অভিবাসনের ঢেউ তৈরি করেছে, যার গন্তব্য এখন সাইপ্রাস।
তারা মনে করছেন, এই প্রক্রিয়া যদি অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে ভবিষ্যতে সাইপ্রাসের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।