এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এ বছর ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণিতে এই ভয়াবহ ফলের পেছনে রয়েছে দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি ও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গণিতভীতি।
বাংলাদেশ শিক্ষা-তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ৬৪ হাজার ১৪৭ জন গণিত শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ শিক্ষক গণিতে অনার্স বা মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। অর্থাৎ, ৮৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষকই বিষয়ভিত্তিকভাবে অদক্ষ।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ শিক্ষকদের একটি বড় অংশ গণিতকে নিজেরাই দুর্বোধ্য মনে করেন। ফলে ছাত্রছাত্রীদের গাণিতিক ধারণা বুঝিয়ে শেখানোর পরিবর্তে মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করতেই বেশি মনোযোগ দেন। এতে করে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণী দক্ষতা গড়ে ওঠে না, গণিতের মূল গঠন ও ব্যবহারিক প্রক্রিয়া তারা আয়ত্ত করতে পারে না।
এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার গণিতে ৭৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অথচ বাংলায় এই হার ৯৭.২৭ শতাংশ, রসায়নে ৯৪.৭৬ শতাংশ এবং পদার্থবিজ্ঞানে ৯৪.০২ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে সবচেয়ে বাজে অবস্থা- সেখানে গণিতে ফেল করেছে ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণিত শিক্ষকদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ পদার্থ-রসায়নের সঙ্গে মিলিয়ে বিএসসি করেছেন, আর ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ অন্য বিষয়ের সঙ্গে গণিত নিয়ে বিএসসি করেছেন। সুতরাং, গণিতে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শেখার অভিজ্ঞতা হচ্ছে না।
গণিতভীতি শুধু মাধ্যমিকে নয়, শুরু হয় প্রাথমিক থেকেই। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)-এর ২০১৯ সালের এক গবেষণা জানায়, ময়মনসিংহে পরিচালিত এক জরিপে অংশ নেওয়া শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষক গণিতকে কঠিন বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সহকারী শিক্ষক থেকে শুরু করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই গণিত শেখাতে ‘ডিফিকাল্টি’ অনুভব করেন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরসহ মোট ৪০০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া সহকারী শিক্ষকদের ১৬ শতাংশ শূন্য থেকে পাঁচ বছর, ১৯ শতাংশ পাঁচ থেকে ১০ বছর, ৩৭ শতাংশ ১০ থেকে ১৫ বছর, ৯ শতাংশ ১৫ থেকে ২০ বছর এবং ১৯ শতাংশ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের শতভাগই গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন বলে মত দেন।
এ ছাড়া শিক্ষকদের কাছে গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন অনুভূত হয় বলে মত দিয়েছেন ৭৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষক। আর জরিপে অংশ নেওয়া সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরদের শতভাগই বলেছেন, শিক্ষকরা গণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে ডিফিকাল্টি অনুভব করেন।
শিক্ষাবিদরা বলেন, চিন্তাশক্তি ও যৌক্তিক ক্ষমতার বিকাশে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণিত। প্রতিটি শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। যদিও দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা-সব স্তরের শিক্ষার্থীর মধ্যে একধরনের গণিতভীতি রয়েছে। বিশেষ করে, এ ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে প্রাথমিক থেকেই।
গণিতভীতি দূর করতে শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের তাগিদ দিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণিতভীতি দূর করতে অনেক দেশ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ফিনল্যান্ড। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। এখানে কোনো আলাদা পরীক্ষা বা গ্রেডিং পদ্ধতি নেই। শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শেখে। গণিত তাদের কাছে আনন্দের একটি বিষয়। যুক্তরাজ্যে গণিত শেখানোর জন্য গেম-ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন-শিক্ষার্থীরা খেলতে খেলতে যোগ-বিয়োগ বা গুণ-ভাগ শেখে।
এতে তারা গণিতকে মজার একটি খেলা হিসেবে গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু স্কুলে মন্টেসরি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এখানে গণিত শেখানোর জন্য বাস্তব উপকরণ ব্যবহার করা হয়। শিক্ষার্থীরা নিজের হাতে সংখ্যা গুনে শেখে। এতে তাদের মনে গণিতভীতি তৈরি হয় না।