ঢাকা শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

আমেরিকা কি ভেনেজুয়েলা আক্রমণ করতে চলেছে?

সৈয়দ মুহাম্মদ আজম
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৫, ০৭:৪৮ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ক্যারিবীয় সাগরে মার্কিন সেনারা বেসামরিক নৌকাগুলোতে অন্তত পাঁচটি প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এই নৌকাগুলো ভেনেজুয়েলার মাদক কার্টেলের সদস্যদের ছিল, যাদের মার্কিন সরকার ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এসব হামলায় অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছে। কংগ্রেসকে পাঠানো এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্টেলগুলোর সঙ্গে ‘সশস্ত্র সংঘাতে’ রয়েছে।

ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এখন প্রায় যুদ্ধকালীন মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রায় ১০ হাজার সেনা, গাইডেড মিসাইল ধ্বংসকারী জাহাজ, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন, এমনকি বিশেষ অভিযান বাহিনী বহনের জন্য তৈরি এক গোপন নৌযান পর্যন্ত সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সমাবেশের অগ্নিশক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিডওয়ে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণকেও ছাড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভেনেজুয়েলার উপকূল থেকে ৯০ মাইলেরও কম দূরে বিশেষ অভিযান হেলিকপ্টার দেখা গেছে।

এদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) গোপন অভিযান অনুমোদন দিয়েছে। গত বুধবার ট্রাম্প নিজেই তা স্বীকার করে জানান, এসব অভিযান ‘গোপন’ নয়। তিনি আরও ইঙ্গিত দেন, ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার বিষয়টিও বিবেচনাধীন।

একই সপ্তাহে জানা যায়, সর্বশেষ নৌকা হামলার পর কয়েকজন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। এই সংঘাতের প্রথম যুদ্ধবন্দি হিসেবেই এটি পদক্ষেপ গণ্য। এদিকে মার্কিন দক্ষিণ কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল অ্যালভিন হোলসি আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণও স্পষ্ট নয়। তবে তার পদত্যাগের সময়টা যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সব মিলিয়ে গুঞ্জন জোরালো হচ্ছে, ওয়াশিংটন কি সত্যিই প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে? বুধবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মাদুরো কড়া ভাষায় বলেন, ‘শাসন পরিবর্তনের নামে নতুন আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়া চাই না। সিআইএ-র পরিকল্পিত অভ্যুত্থানকেও নয়।’

এদিকে ট্রাম্প সাংবাদিকদের প্রশ্নে মাদুরোকে উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি শুধু মন্তব্য করেন, ‘এটা একেবারেই হাস্যকর প্রশ্ন।’ হোয়াইট হাউস নাকি মাদুরোর একটি প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে, যেখানে তিনি তিন বছরের মধ্যে পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ট্রাম্পের এই কঠোর অবস্থান ভেনেজুয়েলার বিরোধীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। সম্প্রতি নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী বিরোধী নেত্রী মারিয়া করিনা মাচাদো পুরস্কারটি উৎসর্গ করেছেন ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৃঢ় সমর্থনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে’। তার মতে, মাদুরো কেবল ‘বিশ্বাসযোগ্য ও ঘনিয়ে আসা সামরিক হুমকির মুখেই’ ক্ষমতা ছাড়বেন।

সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, শিগগিরই ভেনেজুয়েলার মাদকচক্রের কথিত ঘাঁটিগুলোর ওপর হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্যবস্তু হতে পারে মাদক ল্যাব, বিমানঘাঁটি বা সরকার-সমর্থিত মিলিশিয়াদের শিবির।

তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এটি হয়তো মাদুরো সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবেই থাকবে, সরাসরি যুদ্ধ নয়। তবু হোয়াইট হাউসের বার্তা স্পষ্ট, প্রয়োজনে আমেরিকা ভেনেজুয়েলার নেতৃত্বকেই লক্ষ্যবস্তু করবে। আবার অনেকের মতে, তারা শুধু ক্যারিবীয় এলাকায় নৌবহর বাড়িয়ে ভয় দেখাবে, স্থল আক্রমণ চালাবে না।

ভেনেজুয়েলায় মার্কিন-বিরোধী সরকার থাকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই ভালো সংবাদ নয়। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ও তার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা তথা পূর্বসূরি হুগো শ্যাভেজের আমল থেকেই ওয়াশিংটন ও কারাকাসের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে।

২০০০ সালে ক্ষমতায় এসে ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাসন করেন শ্যাভেজ। তার নেতৃত্বে বামপন্থী, বলিভার-অনুপ্রাণিত সমাজতান্ত্রিক সরকার গড়ে ওঠে, যা শুরু থেকেই লাতিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাবের কঠোর বিরোধিতা করে আসছিল। মাদুরোও সেই ঐতিহ্যই বজায় রেখেছেন। রাশিয়া, ইরান ও কিউবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে তিনি মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

গত এক দশক ধরে ভেনেজুয়েলার তেলনির্ভর অর্থনীতি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে টানা মন্দায় আছে। দেশটি চরম মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত। সঙ্গে যোগ হয়েছে নাগরিক স্বাধীনতা ও বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন, সহিংস অপরাধের উত্থান এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতি। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬০ লাখেরও বেশি অধিবাসী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, যা এখন বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী সঙ্কটগুলোর একটি।

ট্রাম্পের আগের মেয়াদ থেকেই মাদুরোকে সরানো ওয়াশিংটনের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও পরে গুয়াইদোকে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পরও বাইডেন প্রশাসন মাদুরোর প্রতিদ্বন্দ্বীকেই বৈধ বিজয়ী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ ও গোপন অভিযান সব দিকেই ওয়াশিংটন সক্রিয় ছিল।

এবারের পরিস্থিতি আরও জটিল। ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্টভাবে লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাব পুনর্স্থাপনে মনোনিবেশ করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর নেতৃত্বে এই অবস্থান আরও কঠোর হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই মাদুরোর বিরুদ্ধে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ কৌশলের প্রবল সমর্থক।

চ্যাথাম হাউসের লাতিন আমেরিকা বিষয়ক সিনিয়র ফেলো ক্রিস সাবাতিনি বলেছেন, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো তার কাছে ছিল ‘অসমাপ্ত কাজ’। সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধিকেও তিনি সেই নীতিরই ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখছেন। তার ভাষায়, “এবার পার্থক্যটা শুধু সামরিক শক্তির ওপর জোর দেওয়ায় নয় বরং হোয়াইট হাউসের নীতি এখন এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যা ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) সমর্থক শিবিরের মন জয় করার উদ্দেশ্যে ক্যালিব্রেট করা।’

এর মানে, ট্রাম্প এখন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্টকে মাদক ও অভিবাসন ইস্যুতে লক্ষ্যবস্তু করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন, মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে গ্যাং, মাদক ও অভিবাসনকে কার্যত ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ সপ্তাহে তিনি আরও দাবি করেছেন, সিআইএ’র গোপন অভিযানে অনুমোদন দিয়েছেন কারণ ‘ভেনেজুয়েলা তাদের কারাগারগুলো খালি করে বন্দিদের আমেরিকায় পাঠিয়েছে।’ তবে এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

ভেনেজুয়েলায় ‘কার্টেল দে লস সোলস’ নামে পরিচিত একটি সামরিক-অপরাধী চক্রকে সম্প্রতি সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে ওয়াশিংটন। এর অর্থ, আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে মাদুরো এখন এমন একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রধান। এই সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত বিধায় তাকেও সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা অসম্ভব নয়।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, মাদকের ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলা নিজে বড় কোনো উৎপাদক দেশ নয়। ‘কার্টেল দে লস সোলস’ও আসলে কোনো সুসংগঠিত মাদকচক্র নয়, বরং ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীর একগুচ্ছ প্রভাবশালী জেনারেলের আলগা নেটওয়ার্ক, যারা নিজ নিজ এলাকায় অপরাধমূলক করবার নিয়ন্ত্রণ করে।

লাতিন আমেরিকার সংগঠিত অপরাধ পর্যবেক্ষক ইনসাইট ক্রাইমের সহ-পরিচালক জেরেমি ম্যাকডারমট এটিকে ‘সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে,  মাদুরো তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে ভৌগোলিক অঞ্চলের ওপর এবং সেই অঞ্চলে চলমান অপরাধমূলক উদ্যোগের ওপর অধস্তনদের নিয়ন্ত্রণ রাখেন।

ওয়াশিংটনের এই নীতির আইনি ও নৈতিক দিক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসনের দাবি, এটি আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ, কারণ এসব মাদক আমেরিকান সমাজের ক্ষতি করছে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, ‘অপরাধকে যুদ্ধ হিসেবে দেখা’ বিপজ্জনক প্রবণতা। এটি মূল সমস্যার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখে, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মাদকের চাহিদা ব্যাপক।

ভেনেজুয়েলার বিরোধীরা বিশ্বাস করেন, সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপই অবশেষে শাসনব্যবস্থাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে পারে। তাদের ভাষায়, ‘দুর্নীতি ও মাদক কারবারই সেনাবাহিনীর আনুগত্যের আঠা।’

তবু প্রশ্ন থেকে যায়, শাসন পরিবর্তন কি আদৌ সম্ভব? ইতিহাস বলছে, এ ধরনের অভিযান যেমন ১৯৮৯ সালে পানামায় সফল হয়েছিল, তেমনটাই ভেনেজুয়েলায় পুনরাবৃত্তি করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেশটি আকারে অনেক বড়, রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি ভঙ্গুর।

বাইডেন প্রশাসনের প্রাক্তন মাদকবিরোধী প্রতিরক্ষা বিভাগের উপ-সহকারী সচিব জেমস সেঞ্জ বলেন, ‘একটা বড় প্রশ্ন যে, আমরা কি পাচার ও অবৈধ মাদককে কেবল অপরাধ হিসেবে দেখব, নাকি জাতির নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য শারীরিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে সামরিক ব্যবহারের প্রয়োজন মনে করব।’

ট্রাম্পের আগ্রাসী অবস্থান সত্ত্বেও বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে যে বাহিনী মোতায়েন আছে, তা পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে ড্রোন হামলা বা বিশেষ অভিযানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ট্রাম্প কি সত্যিই মাদুরোকে সরাতে আগ্রহী, নাকি শুধু দেশীয় রাজনৈতিক বার্তা দিতে চান? সামরিক পদক্ষেপ হলে তা দ্রুত ও নির্ণায়ক হবে কি না, সেটাই এখনো অজানা।

একই সঙ্গে এই আশঙ্কাও জোরালো হচ্ছে, যদি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়, তবে আরও লাখ লাখ ভেনেজুয়েলাবাসী দেশ ছেড়ে আমেরিকার সীমান্তে আশ্রয় চাইবে। আর সেটা ট্রাম্পের জন্য নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।