বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আব্দুল আহাদ, সিলেট 

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:৪০ পিএম

তানজিনারা কেন বিদ্যালয়ে যেতে চাইছে না?

আব্দুল আহাদ, সিলেট 

প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৫, ১১:৪০ পিএম

তানজিনারা কেন বিদ্যালয়ে যেতে চাইছে না?

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিনা আক্তার নিপা প্রতিদিন ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠত, স্কুলের ড্রেস পরত, ব্যাগ গোছাত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সে প্রায়ই স্কুলে যায় না। একদিন মা বললেন, ‘‘সে এখন খুব চুপচাপ, মাঝে মধ্যে বলে ‘স্কুলে ভালো লাগে না, কেউ খেলতেও ডাকে না’।” নিপার এই গল্প আজ একা নয়। সিলেটের হাজারো শিশু একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

সম্প্রতি সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার গত এক বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রশ্ন উঠছে ছাত্রছাত্রীরা কেন নিয়মিতভাবে স্কুলে যাচ্ছে না? এই বাড়তে থাকা অনুপস্থিতির পেছনে রয়েছে একাধিক সামাজিক, পারিবারিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, এর পেছনে রয়েছে গল্প, অভিমান, ভয় এবং কখনো কখনো নীরব কান্না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশেষ করে সরকারি ও আধা-সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে গড় অনুপস্থিতির হার গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গ্রামীণ এলাকার তুলনায় শহুরে এলাকায় এই হার কিছুটা বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের স্কুলে অনুপস্থিতির মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, স্কুলে নিরাপত্তা ও সহমর্মিতার অভাব, একঘেয়ে পাঠ্যক্রম, প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি এবং অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব। শারীরিক অসুস্থতা যেমন অনুপস্থিতির একটি বড় কারণ, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও অনেক সময় অদৃশ্য থেকে যায়। অনেক শিশুই স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হয়, কেউ হয়তো ক্লাসে পিছিয়ে পড়ায় নিজের জায়গা খুঁজে পায় না।

সিলেটের খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রাশেদ নেওয়াজ জানান, অনেক ছাত্র সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে পারে না, কারণ তারা গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইলে গেম খেলে বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। আবার কেউ কেউ ক্লাসে পিছিয়ে পড়ার ভয়ে ইচ্ছা করেই অনুপস্থিত থাকে।

তিনি আরও বলেন, অনেক ছাত্র এখন ক্লাসে মনোযোগ দেয় না। এমনও আছে হাতে বই নেই, মুখে কথা নেই। আমি টের পাইÑ কেউ ওদের ঠিকঠাক শুনছে না। এই ‘শোনা’র অভাবই ওদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, স্কুলে পাঠদানের পদ্ধতিকে আরও আনন্দদায়ক ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিবেশের উন্নয়নেও নজর দিতে হবে। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিং সুবিধা বাড়ানো, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারসাম্য আনার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে সরকার ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন মিড-ডে মিল, স্কুল কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম ও স্কুলে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ। তবে অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক বলছেন, এসব পদক্ষেপ মাঠপর্যায়ে ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং এবং অভিভাবক সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সময় থাকতেই এই প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, ভবিষ্যতে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। অনুপস্থিতির প্রবণতা কমাতে হলে স্কুলে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। ক্লাসে শিশুরা যেন কথা বলতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে, ভুল করলে যেন তিরস্কার না পায়Ñ এই আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা জরুরি।

সিলেট মহানগরীর উপশহর এলাকার একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাফি মাহমুদ জানায়, টিচার কিছু জিজ্ঞেস করলে ভয় লাগে। সহপাঠীরা হাসাহাসি করে। আমি চাই না স্কুলে যেতে। তার মা বললেন, ‘ছেলের মনমতো স্কুলের পরিবেশ পায় না। আমরা কাউন্সেলিংয়ের কথা ভাবছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেটা ক্লাস ফাইভে পড়ে। আগে খুব উৎসাহ নিয়ে যেত, এখন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই চায় না। মাঝে মাঝে বলে, সবাই আমাকে নিয়ে হাসে। আমি বুঝি, ওর সমস্যা শুধু শরীরে না, মনে।’

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, “আমরা সবসময় বলি ‘স্কুলে যাও’, কিন্তু জিজ্ঞেস করি না তুমি স্কুলে থাকতে কেমন অনুভব করো?”

করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেক শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় বাড়িতে থাকার ফলে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া ও পড়াশোনার অভ্যাস হারিয়ে ফেলা, অনিয়মিত পড়াশোনা, অনলাইন ক্লাসের অভিজ্ঞতাÑ সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।

নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আয়া হালিমা খাতুন বলেন, “আমার মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে। মাঝে মাঝে বলে, ‘পেটে ব্যথা’, কিন্তু বুঝি, ওর আসলে মন ভালো না। স্কুলে কেউ কথা বলে না, বন্ধু কম।”

এমনও দেখা গেছে, কিছু অভিভাবক বাচ্চাকে কাজে লাগাতে স্কুলে পাঠাতে চান না, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা বা নগরীর কলোনিগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। শিশুশ্রমের ছায়াও অনুপস্থিতির একটি নির্মম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সিলেটের লামাবাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা মাহজাবিন সুলতানা বলেন, আমি অফিস করি, মেয়েকে একা স্কুলে পাঠাতে ভয় হয়। গাড়ি নেই, নিরাপত্তার ভরসা নেই। এমন দিনে বললেই বলিÑ ‘থাক, আজ যাস না’। এতে হয়তো আমি নিজেই অনুপস্থিতিকে স্বাভাবিক করে ফেলেছি।

লামাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা আনজুমানারা বেগম বলেন, একসময় ছাত্ররা স্কুলে আসত শুধু পড়তে নয়, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে। এখন মোবাইল আছে, গেম আছে, স্কুলকে কেউ আর ‘দেখার জায়গা’ মনে করে না। আবার অনেক অভিভাবক রুজি-রোজগারের জন্য বাচ্চাকে কাজে পাঠিয়ে দেন।

সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সাখাওয়াত এরশেদ বলেন, স্কুল কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম ও স্কুলে শিশুবান্ধব পরিবেশ অনেক স্কুলে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জায়গার অভাবে তা করা যায় না। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছি। মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা রয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে আমরা চেষ্টা করছি।

শিক্ষা শুধু ক্লাসরুম আর বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিশুর মুখের হাসি, চোখের আত্মবিশ্বাস এসবই শিক্ষার অংশ। স্কুলে অনুপস্থিতির গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কোথায় যেন কিছুটা ছেঁকে ফেলেছি। সময় এসেছে সেই ছেঁকে যাওয়া জায়গাগুলো জোড়া লাগানোর। শিশুদের স্কুলে ফিরে আনতে হলে শুধু নির্দেশনা নয়, দরকার ভালোবাসা, বোঝাপড়া এবং একটুখানি শোনা। কারণ প্রতিটি অনুপস্থিতির পেছনে হয়তো লুকিয়ে আছে এমন এক গল্প যা কেউ শোনেনি।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!