ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

বেশির ভাগ হাসপাতালেই প্রস্তুত নয় ডেঙ্গু কর্নার

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: মে ১, ২০২৫, ০২:৫১ এএম
ছবিঃ রূপালী বাংলাদেশ

চলতি বছরের শুরু থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। বছরের শুরু থেকে গত রোববার পর্যন্ত রোগীর আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ২ হাজারের ঘর। মারা গেছেন ১৯ জন। এডিসের লার্ভা ধ্বংসে দুই সিটির ব্যর্থতা, অতিবৃষ্টি-অতিগরমের মতো বৈরী আবহাওয়ার কারণে সম্প্রতি বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। যদিও ডেঙ্গুর ভরা মৌসুম এখনো শুরু হয়নি; তবুও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শংকা তৈরি হয়েছে। এখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বর্ষার সময় মহামারির আশংকাও করছেন তারা। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় এখনো পর্যাপ্ত পরিকল্পনা নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের সব হাসপাতালের ডেঙ্গু কর্নারগুলোকে এখনো প্রস্তুত করা হয়নি। অন্যান্য বছর কয়েকটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড ওয়ার্ড থাকলেও চলতি বছর এখনো এসব ওয়ার্ডে অন্যান্য রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর সংখ্যা বাড়লে পর্যাপ্ত সেবাপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপ বিশ্লেষণ করে করে দেখা যায়, কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি যে, বাড়াতে হয়েছে ওয়ার্ডও। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড), কুর্মিটোলার মতো হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ থাকে সবচেয়ে বেশি। জুন-জুলাইয়ে এসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের তিল ধারণেরও জায়গা থাকে না। তাই এসব হাসপাতালে এখনই ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
 
সরেজমিনে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন একশজনের মতো। চলতি বছর এ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন আটজন। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালটি বিগত বছরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ডেডিকেটেড ওয়ার্ডের পাশাপাশি সক্রিয় ছিল ডেঙ্গু কর্নার। কিন্তু চলতি বছর এখনো তেমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। এমনকি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীদের আলাদাও করা হচ্ছে না। তাদের কোনো মশারিও দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সাধারণ রোগীদের মধ্যেও অস্বস্তি বিরাজ করছে।

চলতি বছর কেন এখনো ডেঙ্গু কর্নার বা আলাদা ওয়ার্ড করা হয়নি জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মেজবাহুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় আমাদের শতভাগ প্রচেষ্টা থাকবে। এখন যেহেতু রোগীর সংখ্যা কম তাই আলাদা করে ডেডিকেটেড ওয়ার্ড করা হয়নি। তবে খুব শিগগিরই এটি করা হবে।

একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেলেও। হাসপাতালটিতে সবসময়ই রোগীর চাপ থাকে অনেক বেশি। ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের সময়ও অন্যান্য হাসপাতালে সিট না পেয়ে এখানেই আসেন চিকিৎসা নিতে। কিন্তু এখনো হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় নেই তেমন প্রস্তুতি। ভরা মৌসুমে তাহলে পরিস্থিতি কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদেরও। হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগী শাহ আলম বলেন, কয়দিন আগেই আমার পাশের বেডে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। আমাদের সঙ্গেই চিকিৎসা দিয়েছেন ডাক্তাররা। সব সময় আতঙ্কে থেকেছি নিজে না আক্রান্ত হই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি থাকবে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও যেন ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করা হয়। তাহলে ওই রোগীদেরও চিকিৎসাসেবা নির্বিঘ্ন হবে। অন্যান্য রোগীরাও স্বস্তিতে থাকবে।
 
ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী প্রকোপের সময় ২০২৩ সালে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য পৃথক ডেঙ্গু কর্নার চালু করা হয়। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ওয়ার্ড চালু করে তৎকালীন সরকার। জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা পেতে ১৬২৬৩ হটলাইন সেবা চালু করা হয়। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু রোগীর রোগ নির্ণয় সুবিধার্থে সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু টেস্ট ১০০ টাকার পরিবর্তে ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বর্তমান সরকারও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সরকার এবার বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌথ উদ্যোগে নতুন পথে হাঁটছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে ওলবাচিয়া ও সেরোলজিক্যাল জরিপ শুরু করতে যাচ্ছি। সেরোলজিক্যাল জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগে সংক্রমণের হার ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নিরূপণ করা হবে। রক্তের নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যাবে, কারা পূর্বে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কোন এলাকায় ঝুঁকি বেশি। আর ‘ওলবাচিয়া’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই পদ্ধতিতে মশার দেহে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো হয়, যা ডেঙ্গু ভাইরাস বহনে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে মশা কামড়ালেও ভাইরাস ছড়ায় না। পাশাপাশি সব হাসপাতালে যাতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য আলাদা কর্নার এবং ওয়ার্ড ডেডিকেটেড করা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায়। কোনো ঘাটতি হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর এ পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পাবে। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে বিশেষ করে জুন-জুলাইয়ে ভয়াবহ হতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ হিসেবে এডিস মশার প্রজননস্থল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিশেষ করে রাজধানী বা রাজধানীর বাইরে যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসাধীন তাদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে ওইসব বাড়িতে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে। পাশাপাশি রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যবস্থাও জরুরি। নইলে অন্যান্যবারের মতো মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
 
এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে। এমন পরিস্থিতিতে আর নির্দিষ্ট সময় না বরং সারা বছর এডিস মশা নিধনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হলে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। তবে তাদের এই কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মনিটরিং করতে হবে।