নিষেধাজ্ঞার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো সচল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডি ও পেজ। কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা দলটির ওয়েবসাইট বাংলাদেশ থেকে ‘ব্লক’ থাকলেও, তাদের ফেসবুক, টুইটার, টিকটক এবং টেলিগ্রাম এখনো সক্রিয়। আর এসব অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিনিয়ত ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা তথ্য, গুজব এবং রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা। বিশেষ করে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করে সাধারণ জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির প্রয়াস দেখা যায় এসব অ্যাকাউন্টে।
সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে আওয়ামী লীগের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
গত ১০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এনসিপির নেতৃত্বে হওয়া এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। আওয়ামী লীগের সাইবার স্পেসের কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে তখন দায়িত্ব বর্তায় বিটিআরসির ওপর।
বিটিআরসির পক্ষ থেকে তখন গণমাধ্যমকে জানানো হয়, আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট বন্ধ করা হবে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধে যোগাযোগ করা হবে ফেসবুক, টুইটার, টিকটকের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এমন পরিস্থিতিতে দুই মাস পেরুলেও শুধু আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট ছাড়া দলটির বাকি সব ডিজিটাল স্পেস সচল রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যায় না। তবে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন ব্যবহার করে এতে প্রবেশ করা যায়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমায় ‘ব্লক’ হয়ে আছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী।
তবে এখনো সচল রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ অনুসারী থাকা ফেসবুকে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ। প্রায় সাড়ে ৯ লাখ অনুসারী থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের আরেক অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ। আরও সচল রয়েছে টিকটকে আওয়ামী লীগের আইডি, এতে ৩০ হাজারের বেশি ফলোয়ার রয়েছে।
এ ছাড়াও এক্স-এ (সাবেক টুইটার) আওয়ামী লীগ এবং এর মিডিয়া উইংয়ের দুটি পৃথক ভেরিফায়েড পেইজ এখনো সচল। পাশাপাশি সচল আওয়ামী লীগের টেলিগ্রাম চ্যানেল। এতে প্রায় ১ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তবে ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ইউটিউবে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড চ্যানেলটি এখন বন্ধ রয়েছে। গত সোমবার সোশ্যাল মিডিয়াগুলো বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের প্রায় প্রায় সব সোশ্যাল মিডিয়া ঘুরে মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানোর প্রয়াস দেখা যায়। পাশাপাশি বিরোধী মত দমনে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাও ছড়ানো হচ্ছে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে। কিছুক্ষেত্রে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করেও বিতর্কিত পোস্ট করা হচ্ছে। বিভিন্ন পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও আক্রমণ করা হচ্ছে। প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও। এমন অবস্থা মোকাবিলায় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
যুবদল নেতা গিয়াসউদ্দিন মামুন বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের যোগসূত্র রয়েছে। যার কারণে এখনো ফ্যাসিবাদীদের সোশ্যাল মিডিয়াগুলো সচল রয়েছে। এসবের দায় বর্তমান সরকার এড়াতে পারে না’।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘এই সরকার আওয়ামী লীগের ভার্চুয়ালের সব জগত বন্ধ করতে চেয়েছিল। কেন তারা বন্ধ করল না বা করছে না সেটা নিয়ে শুধু বিএনপি নয়, দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করছি, নামে-বেনামে ফ্যাসিস্টদের ফেসবুক পেজ, টুইটার অ্যাকাউন্ট, টিকটক আইডি থেকে দেশদ্রোহী অপপ্রচার চলছে কিন্তু সরকার এসব বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অবিলম্বে আওয়ামী লীগ প্রপাগান্ডা, গুজব, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে হলে এসব বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে’।
আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠন সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে অধিকতর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট ‘ব্লক’ করা হয়েছে। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কোনো একটা অ্যাকাউন্ট চাইলেই বন্ধ করা যায় না, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হয় এবং আওয়ামী লীগের বিষয়টি ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে। তারা কী পদক্ষেপ নিল বা কেন নিল না, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দিয়ে আমাদের জানানো হয় না। আবার বিটিআরসি মনিটরিংও করে না সোশ্যাল মিডিয়া। যথাযথ কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছু জানালে, সেটাই সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে জানাই। এখনো যদি কোনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট সক্রিয় থাকে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়, তাহলে তাদের আবারও বিষয়টি জানানো হবে। তবে তারা তাদের নিজস্ব কমিউনিটি গাইডলাইন এবং অন্যান্য বিধিমালা অনুযায়ীই ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’