জীবনরক্ষাকারী ৭৩৯টি ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে। এ ছাড়া ১৯৯৪ সালে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ওষুধের দাম নির্ধারণের আংশিক ক্ষমতা দিয়ে জারি করা সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করে ১৯৯৩ সালের সরকারি গেজেট পুনর্বহাল করেছেন আদালত। সার্কুলার চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে স্বাস্থ্য সচিব, ডিজি হেলথ, ডিজি ড্রাগ, ওষুধ মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
রিটের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট সঞ্জয় মন্ডল। ওষুধ মালিক সমিতির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট এস. কে. মোরশেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) সৈয়দ এজাজ করিব। এ রায়ের ফলে দেশের বেশির ভাগ ওষুধের দাম নির্ধারণের এখতিয়ার উৎপাদনকারীদের পরিবর্তে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রিটকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানান, ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ১১ ধারায় সরকারকে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতে ১৯৯৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৭৩৯টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি সার্কুলারের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা সীমিত করে মাত্র ১৭৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়। বাকি সব ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে।
এই সার্কুলারকে চ্যালেঞ্জ করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) ২০১৮ সালে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করে। হাইকোর্ট তখন রুল জারি করে জানতে চান, কেন ওই সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সৈয়দ মো. দস্তগীর হোসেন এবং বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের আদালত রুল জারি করে সার্কুলারকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না সে মর্মে জানতে চান। এরপর আজ চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণা করেন আদালত।
আইনজীবী মোরসেদ আদালতে যুক্তি দেন, জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সরাসরি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে সীমিত করে দেওয়া নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করে। রায়ে আদালত সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদের আলোকে নির্দেশ দেন যে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করারও নির্দেশ দিয়েছেন।
রিটকারীর আইনজীবী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জানান, বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির হাতে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা থাকার ফলে সাধারণ মানুষকে বেশি দামে কিনতে হয়। গত ১৭ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের তালিকা করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। ওই তালিকায় যেসব ওষুধের নাম থাকবে সবটির দাম সরকারকেই নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মানুষের রোগ-শোকের অন্যতম প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কোম্পানি নিজেদের ইচ্ছেমতো বাড়াচ্ছে তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নির্ধারিত দামের কোনো তোয়াক্কা না করেই দিনের পর দিন চালাচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতা। বছরের শুরু থেকে গত ৭ মাসে দেশে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে জরুরি ব্যবহার্য ওষুধের দাম। এতে করে নিত্যপণ্যে কাটছাঁট করে হলেও জীবন বাঁচাতে বাড়তি দাম দিয়ে ওষুধ কিনতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। যদিও ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যকে; কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপিআই শিল্পপার্ককে কার্যকর করে এখানেই কাঁচামাল তৈরি সম্ভব। দেশে অনেক অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্ট রয়েছেন তাদের কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই কাঁচামাল তৈরি করা গেলে ওষুধ শিল্পের মতোই বড় শিল্পটিতে যেমন কাঁচামাল আমদানি করতে হবে না তেমনি কোম্পানিগুলো ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যকে দায়ী করে প্রতিনিয়ত ওষুধের দাম বাড়াতে পারত না।
দেশে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত কয়েক কোটি মানুষ। এক গবেষণামতে, একজন রোগীর গড় চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ ভাগই যায় ওষুধ কেনার পেছনে। ফলে ওষুধ কিনতে গিয়েই প্রতি বছর দরিদ্র হন অনেক রোগী। এসব রোগীর কথা চিন্তা করে গত বছর তিন ভাগের এক ভাগ দামে ওষুধ বিক্রির উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘সরকারি ফার্মেসি’গুলোতে মিলবে ২৫০ ধরনের ওষুধ। তা দিয়েই ৮৫ ভাগ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু গত ৩১ বছরেও নির্ধারিত ১১৭টি ওষুধের দাম তালিকা পরিবর্তন করেনি কোনো সরকার।
হাইকোর্টের এ রায়ে ওষুধের বাজারে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরবে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যেখানে ডলারের ঊর্ধ্বমুখি মূল্যের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে অজুহাতে ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়ে হলেও কাঁচামাল দেশেই উৎপাদন করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে কাঁচামাল আমদানির অজুহাতে দাম বাড়ার অজুহাত কমে যাবে। তবে এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বাজার তদারকিতে আরও সক্রিয় হতে হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন