ঢাকা মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কত মধু আলিম উদ্দিন  ওয়াক্ফ এস্টেটে? 

মো. সাহাব উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫, ০৮:৫৭ এএম
চকরিয়া

* ১৬ মাসে ৭ মামলা

চকরিয়ায় হাজী আলিম উদ্দিন ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি পদকে ঘিরে গত ১৬ মাসে অন্তত সাতটি মামলা, একাধিক সংঘর্ষ ও অস্ত্রের মহড়ার ঘটনায় সরগরম থানা এবং আদালত পাড়া। প্রশ্ন উঠেছেÑ এই ওয়াক্ফ এস্টেট নিয়ে এত সংঘাতের কারণ কী? কত ‘মধু’ আছে আলিম উদ্দিন ওয়াক্ফ এস্টেটে, যার কারণে এত হামলা-মামলা!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্চপিয়া এলাকায় ১৬৮০ একর জমি নিয়ে গঠিত হয় হাজী আলিম উদ্দিন চৌধুরী ওয়াক্ফ এস্টেট। ১৯১৯ সালে নিবন্ধিত এই ওয়াক্ফটি ওয়াকিফ তার একমাত্র ছেলের অকাল মৃত্যু ও দুই মেয়ের জীবিত অবস্থায় ফি-সাবিলিল্লাহ জনহিতকর কাজে দান করেন। তখন থেকেই ওয়ারিশরা পাঁচ বছরের জন্য মোতাওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

২০২২ সালের জুনে সর্বকনিষ্ঠ ওয়ারিশ সুলতান উল ওসমানকে মোতাওয়াল্লিø করা হয়। তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনের খরচ বহন না করা এবং মোতাওয়াল্লিø হওয়ার আগে ২০১৬ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব খাটিয়ে ৪০ একর জমি বিক্রির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসন তাকে অপসারণ করে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ ওয়ারিশ সুলতান লিয়াকত আলীকে মোতাওয়াল্লিø নিযুক্ত করে। উচ্চ আদালতে ওসমানের রিট আবেদনের পরও আদালত ওয়াক্ফ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন।

অভিযোগ রয়েছে, অপসারণের পরও মোতাওয়াল্লিø পদ ধরে রাখতে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন ওসমান। তিনি বাঁশখালীর সাবেক সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হতে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী এবং পুইছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ারও চেষ্টা করেন। সাংসদের দৃষ্টি আর্কষণ করতে মোস্তাফিজুর ছবি দিয়ে টিশার্ট বানিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল করতে দেখা গেছে ওসমানকে। গণঅভুত্থ্যানের পর গত বছরের ৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান তিনি। এর আগে ২৫ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় দায়ের হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ছিলেন তিনি।

ওয়াক্ফ প্রশাসন কর্তৃক মোতাওয়াল্লিø পদ হারানোর পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ওসমান। ওয়াক্ফ এস্টেটের ১ হাজার ৬৮০ একর জমি নিজের দখলে রাখতে এবং লাগিয়তের টাকা নিজের পকেটে নিতে চকরিয়ার ঘোনা এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। রাতের আঁধারে ঘোনা দখলে নিতে একের পর এক সংঘর্ষে জড়ায় ওসমান ও ওয়াক্ফ প্রশাসনের নিযুক্ত মোতাওয়াল্লিø সুলতান লিয়াকত আলীর লোকজন। সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট মাছ চাষির পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগে চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে ওসমানসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে।

মামলায় এজাহারে ওসমানের নির্দেশে অন্য আসামিরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাছের ঘোনায় লুটপাট ও চাষি আবু তাহেরের পা ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আনা হয়। এর আগে ১৭ এপ্রিল আক্তার আহমদ নামের এক বর্গা চাষির ঘোনা থেকে লুটপাট ও মারধর করার অভিযোগে ওসমানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চকরিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ওসমানের নির্দেশে অপরাপর আসামিরা মাছের ঘোনায় লুটপাটের সময় ২০-২৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে এবং চাষিদের হত্যার হুমকি দেয় বলে উল্লেখ করা হয়। এসব ঘটনায় চকরিয়া থানায় ও আদালতে সাতটি মামলা চলমান।

তবে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লিø পদ নিয়ে দুই ওয়ারিশের মধ্যে বিরোধের বলি হচ্ছে সাধারণ চাষিরা। ওয়াক্ফ প্রশাসন কর্তৃক অপসারিত হওয়ার পরও ওয়াক্ফ এস্টেটের সম্পত্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছুদিন পর পর ঘোনা এলাকায় অস্ত্রের মহড়া চালান ওসমান। ফলে লিয়াকত আলীর কাছ থেকে বর্গা নেওয়া চাষিদের ওপর ঘটে হামলার ঘটনা। এতে সাধারণ চাষিরা হামলার শিকারের পাশাপাশি হচ্ছেন মামলার আসামিও।

বর্তমান মোতাওয়াল্লিø সুলতান লিয়াকত আলীর অভিযোগ, ওসমান আইন অমান্য করে মোতাওয়াল্লিø পদ দখল করতে চেষ্টা করছে। ওয়াক্ফ এস্টেটে অস্ত্রের মহড়া, লুটপাট, চাষিদের মারধরসহ নানা অপকর্ম করছে। আমরা প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছি না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সুলতান ওসমানের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেনি। এ সময় তিনি দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার হিসাব বিভাগে কর্মরত জনৈক মারুফের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। একদিন পর মারুফ প্রতিবেদককে পূর্বকোণের অফিসিয়াল নম্বর থেকে ফোন করে নিউজ না করার জন্য সুপারিশ করেন এবং নিউজ করলে পত্রিকার ক্ষতি হবে বলে হুমকি দেন।

হাজী আলিম উদ্দিন ওয়াক্ফ এস্টেট সম্পর্কে লিখিত আইনি মতামত দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়েরা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ ইউছুপ। আইনজীবীর মতামত অনুযায়ী সুলতান লিয়াকত আলীকে বৈধ মোতাওয়াল্লিø এবং সুলতান উল ওসমানের সাথে ওয়াক্ফ এস্টেটের কোনো ধরনের লেনদেনে আইনগত বৈধতা নেই বলে উল্লেখ করা হয়।