রাজনৈতিক অঙ্গনের টানাপোড়েন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘিরে দেশে একটি অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগজনক আবহ তৈরি হয়েছে। গনঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা, জাতীয় পার্টির অফিসে সংঘর্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহিংসতা এবং রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলো জনমনে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে ঘিরে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া জরুরি অবস্থা জারির গুজব রাজনৈতিক উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, অথচ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার এসব গুজবকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
একটি রাষ্ট্রে যখন রাজনৈতিক মতানৈক্য ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করে, তখন গুজব হয় আগুনে ঘি ঢালার মতো। দায়িত্বশীল আচরণ না থাকলে তা শুধু বিভ্রান্তিই ছড়ায় না, বরং গণতান্ত্রিক ধারাকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। গুজব একটি জাতিকে বিভ্রান্ত করতে পারে, একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে, এমনকি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে থমকে দিতে পারে।
এ ধরনের গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক, বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস জন্ম নেয়, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে জাতীয় রাজনীতিতে। বিশেষ করে সেনাপ্রধান, প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির মধ্যকার স্বাভাবিক বৈঠককে কেন্দ্র করে ‘জরুরি অবস্থা’র গুজব ছড়ানো একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়। অথচ এসব বৈঠক রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও সমন্বয়ের অংশ হিসেবেই বিবেচ্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আসন্ন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এই বার্তা স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিতে হবে সকল পর্যায়ে। এই সংকটকালে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে যৌথভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, গুজব নয় বিশ্বাস, সঠিক তথ্য এবং দায়িত্বশীলতাই হতে হবে গণতন্ত্রের মূলভিত্তি।
গুজব সমাজে এক ভয়াবহ ব্যাধি। এটি মুহূর্তের মধ্যে জনমনে আতঙ্ক, বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গুজবের বিস্তার আরও দ্রুত হচ্ছে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটি মিথ্যা তথ্য হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে চোখের পলকে। এর ফলে জনজীবনে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও বিঘিœত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
অতীতে দেখা গেছে, গুজব ছড়িয়ে সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আবার কোনো ভুয়া খবর অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও হয়েছে। তাই গুজব প্রতিরোধে কেবল প্রশাসনের ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমসহ সবাইকে একযোগে দায়িত্ব নিতে হবে।
এ অবস্থায় সরকারের উচিত গুজব ছড়ানোকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজরদারি বাড়ানো এবং জনগণকে নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করা। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের উচিত নিজেদের বক্তব্য ও অবস্থানে আরও দায়িত্বশীল হওয়া। রাজনীতিতে মতানৈক্য থাকতেই পারে, তবে সেই মতানৈক্য যেন দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতাকে নষ্ট না করে, তা নিশ্চিত করাও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব।
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত সঠিক তথ্য দ্রুত জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। গুজবকে দমন করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সত্য প্রচার করা। সেই সঙ্গে গুজব যারা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো- জনসচেতনতা। প্রতিটি নাগরিককে জানতে হবে, যাচাই না করে কোনো তথ্য প্রচার করা বিপজ্জনক। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গুজব যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি এটি ভয়াবহ ক্ষতির কারণও হতে পারে।
আমরা আশা করব, সরকার শক্ত হাতে গুজব প্রতিরোধ করবে। সত্যকে সামনে এনে, আইনের শাসন নিশ্চিত করবে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা রক্ষায় জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন