ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা। কুয়াকাটা মাছঘাটে তখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। মাছের ঝুড়ি, বরফ, শ্রমিক, আড়তদার, পাইকার আর ট্রলারের মালিকদের হাঁকডাকের মধ্যে চুপচাপ এক গলির ভেতর দিয়ে পণ্যবাহী ভ্যান যাচ্ছে জাল নিয়ে। সেখানে মৎস্য অধিদপ্তরের নিষিদ্ধি জাল। সমুদ্রে জেলেরা সেসব অবৈধ জাল ব্যবহার করে সমুদ্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন। একই জাল রশিতে বেঁধে জেলেরা বিভিন্ন নামে ব্যবহার করেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ গড়াজাল, বেড়জাল, বেহুন্দি জাল। সমুদ্রে ব্যবহৃত উল্লেখযোগ্য জালের মধ্যে রয়েছেÑ সাদা জাল, লাল জাল, লম্বা জাল এবং ট্রলিং ট্রলারে ফাইন বা বেহুন্দি জাল। উপকূলের নদী-খালে ব্যবহৃত হয় আটন জাল, বুচনা জাল, চায়না দুয়ারি জাল। আছে কারেন্ট জালও। মৎস্য বিভাগের ৬ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ফাঁসের নিচের জাল ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু উপকূলের জেলেরা সোয়া দুই ইঞ্চি থেকে পৌনে চার ইঞ্চি জালই ব্যবহার করে বেশি। এসব জাল কোথা থেকে আসছে, কে কিনছে, আর প্রশাসন কোথায়Ñ এমন প্রশ্ন মৎস্য বিশেষজ্ঞদের।
পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ মাছঘাট কুয়াকাটা, মহিপুর ও আলীপুরে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে সরকারের নিষিদ্ধ বাহারি নামের জাল। আইন থাকলেও নেই কার্যকর তদারকি। ফলে বাজারগুলো পরিণত হয়েছে অবৈধ জালের অন্যতম প্রধান হাটে। উপকূলীয় এলাকার সচেতন নাগরিক আব্দুস ছত্তার মিয়া। তিনি বলেন, ‘সরকারি নিষিদ্ধ জাল প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। বছরেও একবার অভিযান চালায় না প্রশাসন। এগুলো দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা উদাসীন।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারের একাধিক দোকান ও গুদামে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সূক্ষ্ম ফাঁসযুক্ত জাল। বেশির ভাগ জালই চিংড়ি ও পোনা মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়, যা ২০১১ সালে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবু স্থানীয়ভাবে এই জালের সরবরাহ ও বিক্রি প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলছে।
স্থানীয় এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই জাল ছাড়া মাছ পাই না। সরকার নিষেধ করলেও কেউ বাধা দেয় না।’ অন্য এক জেলে বলেন, ‘সমুদ্রে সব সময় বড় সাইজের মাছ পাওয়া যায় না। লাখ লাখ টাকার বাজার নিয়ে সমুদ্রে যেতে হয়, মাছ না পেলে লোকসান হয়। তাই ছোট ফাঁস নিয়ে যাই। বাজারখরচ লোকসান হয় না।’
সমুদ্রে মাছ উৎপাদনে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিকর বেহুন্দি জাল, গড়াজাল, বেড়জাল। অথচ এ জাল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। দেখার কেউ নেই। কেউ বাধাও দিচ্ছেন না। সর্বশেষ কবে নাগাদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তা বলতে পারেন না বাজার ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন হাজার হাজার পোনা নিধন হচ্ছে। সমুদ্রজীবের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। সৎ জেলেরা বিপদে পড়ছেন। কারণ প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে যাচ্ছেন। দেশের মাছ রপ্তানি কমছে, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এক জেলে বলেন, ‘ট্রলার কেনার অর্থ নেই। অল্প পুঁজিতে বেহুন্দি জাল, গড়াজাল, বেড়জাল করা যায়। অবৈধ জানি, বিক্রি তো হয় খোলামেলা। আমার সব জাল আছে। যখন যে জালের মৌসুম থাকে, তখন সেই জাল ব্যবহার করি।’
খোঁজ জানা গেছেÑ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালের কয়েকটি ফ্যাক্টরি থেকে গোপনে এই জাল উৎপাদন করে ট্রাকযোগে সরবরাহ করা হয় মহিপুর-আলীপুরে। এখানকার পাইকাররা তা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করে, আবার কিছু মালামাল সরাসরি চলে যায় ট্রলারের মালিকদের গুদামে। নামিদামি কিছু প্লাস্টিক কারখানায় গোপনে এই জাল তৈরি হয়, যা ‘পলিমার নেট’ বা ‘হাউজিং জাল’ নামে চালানো হয়। এই পুরো চক্র টিকে আছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তার ছত্রছায়ায়। এ কারণে অভিযানের আগে গোপন খবর পৌঁছে যায় জাল ব্যবসায়ীদের কাছে। তখন দোকান বন্ধ, জাল সরিয়ে ফেলা হয়।
ট্রলার মালিক ও মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রলিং ট্রলারে ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তির বেহুন্দি জাল প্রতি কেজি ১৪৫০-১৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একটি জাল তৈরি করতে ১০০-১১০ কেজি সুতা প্রয়োজন হয়। কালো কট সুতার লম্বা জাল ৪৬০-৫০০ টাকা দরে বিক্রয় হয়। ১৩৫ ফুট প্রস্থ ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতি পিস জাল তৈরি করতে ৩৫-৪০ কেজি সুতায় খরচ হয় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। লাল কট সুতার জাল (৪৫ ফুট দৈর্ঘ্য) ৪৫০-৪৭০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয় জেলেদের। সাদা সুতার জাল প্রতি কেজি ৩৫০-৩৭০ টাকা। জিরো সুতার সাদা জাল প্রতি কেজি ৩৭৫-৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গড়াজাল, বেড়জালসহ অন্যান্য নামের জাল তৈরি করতে ব্যবহৃত প্রতি কেজি সুতা বিক্রি হয় ৩৫০-৪০০ টাকা। এ ছাড়া খালে-বিলে ব্যবহৃত চায়না দুয়ারি প্রতি পিস জালের দাম ৩৮০০-৪০০০ টাকা (৭৫ ফুট লম্বা)। আটন জাল প্রতি কেজি ৩২০-৩৫০ টাকা এবং বুচনা প্রতি পিস ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি কেজি জালে গড়ে ৪০-৫০ টাকা ব্যবসা থাকে দোকানিদের।
এক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুধু বেহুন্দি না, কারেন্ট আর মশারি জালেরও চাহিদা আছে। ফ্যাক্টরি থেকে মাল আসে, কেউ কিছু বলে না।’ একজন স্থানীয় সাংবাদিক বলেন, ‘যখন অভিযান হয়, তখন দোকানে কিছু থাকে না। অভিযানের ছবি তোলা হয়, রিপোর্ট হয়। কিন্তু মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে যায়।’
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব জালের মাধ্যমে প্রতিদিন সমুদ্র থেকে ধরা হচ্ছে কোটি কোটি পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে আর ভবিষ্যতে দেশের মৎস্য উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। পটুয়াখালী উপকূলে এই অবৈধ জাল ব্যবসা বন্ধে আরও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। ৪০ মিমির নিচের সব জাল অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি জোরদার, অবৈধ জাল উৎপাদনে জড়িত কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, সচেতনতা কর্মসূচি বৃদ্ধি, ডিজিটাল ট্রলার রেজিস্ট্রেশন ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু এবং নিষিদ্ধ জাল শনাক্তে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোবাইল টিম গঠনের পরামর্শ তাদের।
ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণা সহকারী বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘নিষিদ্ধ জাল সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা, ডিম ও খাবার নষ্ট করছে। সব অবৈধ জাল অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করতে হবে।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘যতক্ষণে জাল মাছ ধরার উপযোগী না হয়, ততক্ষণ অভিযান চালানো যায় না। দোকানের নতুন জাল বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে কারেন্ট জাল এবং খালে-বিলে ব্যবহৃত বুচনা, আটন ও চায়না দুয়ারি জাল দোকানে থাকলে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আমরা চলতি বছর ৪৮০ পিস জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করেছি। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
উপকূলের হাটগুলো যেন এক একটি ‘জালের রাজধানী’। অথচ এই জাল শুধু মাছ নয়, ভবিষ্যৎও ধ্বংস করছে। যদি এখনই থামানো না যায়, তবে আগামী দিনে মাছ থাকবে না আর জেলেদের যেতে হবে না সাগরে!
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন