ঢাকা বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পিআর নিয়ে গিয়ারে জামায়াত ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫, ১১:৩৪ পিএম

জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে জটিলতা কাটছেই না। এমন অবস্থায় নির্বাচনের আগেই সাংবিধানিক সংস্কার কার্যকরের মাধ্যমে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চরমোনাই পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ আরও তিনটি দল। দলগুলোর নতুন নতুন নানা আবদারে জুলাই সনদ এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পারছে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বরং দলগুলোর একের পর এক শর্তে কাবু হয়ে পড়েছে কমিশন।

প্রথম দফায় এক মাস মেয়াদ বাড়িয়েও কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। ফলে বাড়ানো হয়েছে কমিশনের মেয়াদ। সর্বশেষ ধাপে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হবে কমিশনের তরফে। কিন্তু ঐকমত্য কতটা হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কমিশনের বৈঠকে অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দুই ধরনের অবস্থান রয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট চায় সংবিধান সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া অন্য প্রস্তাবগুলো নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর করতে। সংবিধান সম্পর্কিত বিষয় নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা ইসলামী দল, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল চায় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং বাস্তবায়ন। এই সনদের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন আয়োজনের দাবি এসব দলের। সর্বশেষ বৈঠক থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দলগুলোকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। 

আপাতত চারটি দলের লক্ষ্য ভোটের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার ও বিএনপিকে চাপে রাখা। তাদের একই দাবিতে এই আন্দোলন আগামী নির্বাচনে জোটে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও গুঞ্জন আছে। তবে এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনের কথা থাকলেও শেষে রহস্যজনক কারণে সাড়া দেয়নি। গত সোমবার পৃথক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন পাঁচ দফা দাবিতে এবং খেলাফত মজলিস ছয় দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে। আগের দিন পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচি দেয় মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দলগুলো সনদ বাস্তবায়ন, পিআর, গণহত্যার বিচার, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি এবং জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা, ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহর এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করবে। একই দিনে একই কর্মসূচি হলেও মঞ্চ হবে আলাদা। রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে। 

যুগপৎ কর্মসূচির বিষয়ে গত শনিবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই পাঁচ দল ছাড়াও ছিল এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ। এই তিন দলও ভোটের আগে সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড, জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে একমত। তবে তারা জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় না। তাদের দাবি শুধু উচ্চকক্ষে পিআর। যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেওয়া দুই খেলাফত মজলিসও শুধু উচ্চকক্ষে পিআর চায়। এনসিপি ও এবি পার্টি সূত্র জানিয়েছে, ডানপন্থি ‘ট্যাগ’ এড়াতে তারা এখনই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বা যুগপৎ আন্দোলনে যেতে চায় না। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর সমঝোতা হতে পারে। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণঅধিকার পরিষদ সেখানেই থাকতে চায়। আবার দলটি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন চায়। নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার সূত্র জানিয়েছে, তাদের দাবি জামায়াতের কাছাকাছি হলেও এখনই জোট করবে না।

জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে ৮৪টি সংস্কারের সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। ১১টিতে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা রহিত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, কমিটির মাধ্যমে দুদকের নিয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়াসহ ৯ সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। জামায়াত গভর্নর নিয়োগসংক্রান্ত সিদ্ধান্তসহ কয়েকটিতে নোট অব ডিসেন্ট দিলেও সব কটির বাস্তবায়ন চায়। রাষ্ট্রপতির নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া ইসলামী আন্দোলনের একই অবস্থান। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। বিএনপি চায়, সাংবিধানিক সংস্কার আগামী সংসদে দুই বছরে হবে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন মত দিয়েছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সংসদে সনদ অনুমোদন এবং তা গণভোটে গৃহীত হবে, যাতে কেউ বাতিল করতে না পারে।

গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে তৃতীয় দফার দ্বিতীয় দিনের সংলাপ হলেও কোনো দলই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরেনি। কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সাংবিধানিক আদেশ কিংবা গণভোটে সনদ বাস্তবায়নে মত দিয়েছে। তবে সরকার এখনই সেদিকে না গিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় গুরুত্ব দিচ্ছে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও আলোচনা চালিয়ে যেতে মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দলগুলো নির্বাচনি কৌশল হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে হয়তো। আন্দোলন করা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। এ নিয়ে কিছু বলার নেই।’ সনদ নিয়ে আলোচনার চলমান অবস্থায় আন্দোলনকে বিএনপি কীভাবে দেখেÑ এমন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটাকে দ্বিচারিতা বলা যেতে পারে।’ কারও আপত্তি থাকলে জাতীয় পার্টির বিষয়ে আদালতে যেতে পারে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পরাজিত ফ্যাসিস্টের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচন ভন্ডুল করতে পিআর পদ্ধতি নিয়ে কর্মসূচির ডাক দিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাদের কর্মসূচিকে জনভিত্তিহীন দাবি করে বলেছেন, ভোটের মাঠে দুর্বল জেনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। পাল্টা কর্মসূচি নয়, যৌক্তিক দাবি উপস্থাপনের মাধ্যমেই জনগণের পাশে থাকতে চায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। 

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কারও ওপর চাপ তৈরি নয়, জুলাই অভ্যুত্থান সফল করতেই এই আন্দোলন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হতে হবে। জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া দলগুলোর নেতারা বলেছেন, বিএনপি অভ্যুত্থানের পর অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ক্ষমতায় যাবেই ধরে নিয়ে সংস্কারে বাধা তৈরি করেছে। এতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে সংবিধান সংস্কার করবে কি না। নেতারা বলেন, উচ্চকক্ষের পিআর মানতেই হবে। উচ্চকক্ষে পিআরে রাজি করাতেই পুরো নির্বাচন এই পদ্ধতিতে করার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছে, যাতে আলোচনায় বিএনপিকে কিছু ছাড় দেওয়া যায়। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলে নি¤œকক্ষে পিআরের দাবি বাদ দেওয়া হবে। 

আন্দোলনে নির্বাচন অনিশ্চিত হতে পারে কি নাÑ এ প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ দলগুলো আন্দোলনে নেমেছে। চাপ কি শুধু সনদ বাস্তবায়নের, নাকি আসন ভাগাভাগিরÑ বুঝতে সময় লাগবে। 

আজ বুধবার আবার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসছে কমিশন। দুই দিনের বিরতিতে দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে কথা বলে মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান আগেই জানিয়েছিল কমিশন।