* গাজায় মানবিক করিডোর খুলছে ইসরায়েলি বাহিনী
* প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ পালিয়েছে শহর থেকে
* গতকাল ইসরায়েলি হামলায় ৩৭ নিহত ফিলিস্তিনির মধ্যে ২৪ জনই গাজার
* ‘শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলছে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা: আলজাজিরার প্রতিবেদন
* জাতিসংঘ মহাসচিবের নিন্দা
গাজায় আবারও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমালোচনা আর জাতিসংঘের গণহত্যার অভিযোগ উপেক্ষা করেই গাজা সিটিতে নতুন করে শুরু করা স্থল অভিযান আরও জোরালো করেছে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকার বৃহৎ শহর গাজা সিটিতে গত মঙ্গলবার রাতভর ভারী বিমান হামলার মধ্যেই শহরটির বিভিন্ন অংশে ইসরায়েলের স্থল সেনারা প্রবেশ করে। শহরজুড়ে ব্যাপক বোমা, গুলিবর্ষণ আর ট্যাঙ্ক হামলা অব্যাহত রেখেছে তারা।
তাদের হামলায় গাজা সিটির টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে শহরটি। পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফিলিস্তিনি টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি অথরিটি জানিয়েছে, উত্তর গাজার প্রধান নেটওয়ার্ক লাইনে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা চালানোর পর ইন্টারনেট ও টেলিফোন সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গাজা সিটির বাসিন্দারা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গাজা সিটির সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে বার্তা সংস্থা এপি। তবে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, গত মঙ্গলবার রাতে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নারী, শিশুসহ অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে অধের্কই গাজা সিটিতে নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, নিহতদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিক বা হামাস যোদ্ধাদের সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি, তবে কয়েকজন নারী ও শিশু রয়েছে।
বুধবার গাজা শহরে নতুন করে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনারা। দুই বছরের যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত এ অঞ্চল এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ শহরে আটকে রয়েছে। মঙ্গলবার শুরু হওয়া সর্বশেষ অভিযান মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে এবং সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
বুধবার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৩৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৪ জন গাজা সিটির।
ইসরায়েলি সেনারা বলছে, তারা ‘হামাসের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংসে’ কাজ করছে। তবে এই অভিযানের সময়সীমা জানানো হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে পারে। ইসরায়েলি সেনারা গাজা শহর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ফলে অনেকে দক্ষিণ গাজায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
গাজা শহরে বোমাবর্ষণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবিরাম বিস্ফোরণে কয়েক ডজন বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং নৌবাহিনীর নৌকাগুলোও ইসরায়েলি ট্যাংক এবং জেট বিমানের পাশাপাশি হামলা করছে।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ট্যাঙ্ক আর বিস্ফোরকভর্তি রিমোট কন্ট্রোল সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে নেতানিয়াহু বাহিনী ঢুকে পড়ে শহরের ভেতরে। এরপর রাতভর আরও তীব্র হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। হামাস সম্পূর্ণ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান থামবে না বলেও জানিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী। গাজায় নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই স্থল অভিযানের হুমকি দিয়ে আসছিল ইসরায়েল। গাজা পুরোপুরি দখলে নিতে এবার সেই স্থল অভিযান শুরু করেছে তেল আবিব।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এফি ডেফ্রিন বলেন, ‘গাজা সিটিতে আক্রমণাত্মক স্থলাভিযান শুরু হয়েছে। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কাঠামোবদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান চলবে। প্রয়োজনে সেনা সংখ্যাও বাড়ানো হবে।’
ইসরায়েলের নতুন স্থলাভিযানের মুখে গাজা সিটি ছেড়ে পালাচ্ছে অসহায় ফিলিস্তিনিরা। একমাত্র উপকূলীয় সড়ক ধরে গাধার গাড়িতে, রিকশায়, হেঁটেও দক্ষিণের দিকে পালাচ্ছে তারা। অনুমান করা হচ্ছে, অন্তত ৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ পালিয়েছে, তবে আধা মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এখনো গাজা শহরে রয়েছে। তাদের সবাইকে উপকূলীয় অংশের মানবিক অঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের নতুন স্থল অভিযানের নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ফিলিস্তিন ভূখ-ে চলমান যুদ্ধ নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনিভাবে অসহনীয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘গাজায় যা ঘটছে তা ভয়াবহ। গাজা সিটিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। নিরীহ নাগরিকদের হত্যার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু রাজি থাকলে চলমান সমস্যা সমাধানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সাথে বৈঠক হতে পারে।’ গাজা সিটিতে ইসরায়েলের নতুন স্থল অভিযানকে ভয়াবহ হিসেবে অভিহিত করেছে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ প্রকাশিত এক পোস্টে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন এ হামলা গাজায় মানবিক সংকটকে আরও তীব্র করে তোলার পাশাপাশি জিম্মিদের মুক্তির সম্ভাবনাকেও ঝুঁকিতে ফেলছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধের মধ্যে সাধারণ নাগরিকদের জন্য একটি নতুন পথ খুলে দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। বুধবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গাজা সিটি থেকে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য এই অস্থায়ী করিডোর চালু করা হয়েছে। খবর বার্তা সংস্থা এএফপির। এর আগে গত মঙ্গলবার ভোর থেকেই গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এই অভিযান এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগ এনেছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই অপরাধে উসকানি দিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আরবি ভাষার মুখপাত্র কর্নেল আভিচাই আদরাই বলেন, আজ বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সালাহ আল-দিন স্ট্রিট দিয়ে খোলা এই করিডরটি মাত্র ৪৮ ঘণ্টার জন্য খোলা থাকবে। এর আগে বাসিন্দাদের উপকূলীয় রাস্তা ব্যবহার করে দক্ষিণ দিকের ‘মানবিক অঞ্চলগুলোতে’ যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল সেনাবাহিনী।
গাজায় অনেক ফিলিস্তিনি এএফপিকে জানিয়েছেন, এই ভূখ-ে কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। তারা আবারও বাস্তুচ্যুত হওয়ার চেয়ে বরং নিজেদের বাড়িতেই মারা যেতে প্রস্তুত।
এদিকে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়ে গাজা শহরের পূর্বে তুফাহ এলাকায় অবস্থিত আল-আয়বাকি মসজিদটি ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এ হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনেও। সেই ভিডিও যাচাই করে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে আলজাজিরা। তবে মসজিদে হামলায় কোনো হতাহত হয়েছে কি না, কিংবা এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি পেতে হবে বলে জানিয়েছেন কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা জানান তিনি। কাতারের মুখপাত্র দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রবণতার সঙ্গে আমরা অভ্যস্ত, যেখানে তিনি প্রতিটি ব্যর্থতার পর নিজের বেপরোয়া নীতিকে ঢাকতে এবং যৌক্তিক করতে চেষ্টা করেন। আমরা তাকে একটি বার্তা দিতে চাইÑ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কারণে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন