আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের দল আর কাশফুলের দোলায় যখন শরতের আমেজ চারপাশ ভরে ওঠে, তখনই বাঙালির হৃদয়ে ধ্বনিত হয় উৎসবের আগমনী বার্তা। বছর ঘুরে আবার এসেছে শারদীয় দুর্গাপূজা। এই উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি হয়ে উঠেছে আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতির প্রতীক, যেখানে একসঙ্গে মিলেমিশে যায় ভক্তি, আনন্দ, মিলন আর সাজসজ্জার রঙিন আবহ। পূজার পাঁচ দিন যেন হয়ে ওঠে আলো, রং ও ফ্যাশনের অনন্য সমাবেশ। বাংলার ঘরে ঘরে উৎসব মানেই নতুন সাজপোশাকের আয়োজন। দুর্গাপূজা যতটা আধ্যাত্মিকতার, ততটাই নান্দনিকতারও। প্রতিটি দিনের পূজাকে ঘিরে সাজগোজের আলাদা ধারা লক্ষ্য করা যায়। কারো কাছে অষ্টমীর সকালে লালপাড় সাদা শাড়ি ছাড়া পূজাই অসম্পূর্ণ, আবার কারো কাছে নবমীর সন্ধ্যায় হালকা সালোয়ার-কামিজ কিংবা ফিউশন পোশাকই মানানসই। প্রতিটি রূপই একেকটি আবহ তৈরি করে, যা আনন্দকে নতুন মাত্রা দেয়।
শারদীয়র সাজপোশাকে রঙের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাল ও সাদা দুর্গাপূজার ঐতিহ্যবাহী রং, যা একদিকে শক্তি আর উচ্ছ্বাসের প্রতীক, অন্যদিকে শান্তি ও পবিত্রতার প্রতিচ্ছবি। তবে আধুনিক প্রজন্ম লাল-সাদার গ-ি পেরিয়ে হলুদ, বাসন্তী, আকাশি বা নীল রঙের প্রাণবন্ত ছোঁয়াও যোগ করছে। কেউ কেউ আবার ব্লক, বাটিক কিংবা হ্যান্ডপেইন্ট করা পোশাক বেছে নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা যেমন ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে, তেমনি উৎসবকে আরও বর্ণময় করে তোলে। শাড়ি আর দুর্গাপূজার সম্পর্ক যেন চিরন্তন। শাড়িই নারীর সাজপোশাকের শীর্ষ পছন্দ হিসেবে পূজায় ফিরে আসে বারবার। কাতান, সিল্ক, তাঁত কিংবা জামদানির মতো শাড়িগুলো পূজার কেনাকাটায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। এখনকার তরুণীরা ফিউশন শাড়িতেও আগ্রহী, যেখানে দেশীয় বুননের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ড্রেপিং বা কাটের সংমিশ্রণ ঘটে। অনেকে ইন্দো-ওয়েস্টার্ন গাউন, কুর্তি কিংবা লং ফ্রক পরতে ভালোবাসেন। অলংকারেও এসেছে বৈচিত্র্য।
সোনার গহনা এখনো পূজার সাজে রাজকীয়তা আনে, তবে তরুণ প্রজন্ম অক্সিডাইজড সিলভার বা টেরাকোটা জুয়েলারির দিকেও ঝুঁকছে। পুরুষদের সাজপোশাকেও এখন নতুনত্বের ছাপ স্পষ্ট। একসময় যেখানে পাঞ্জাবি বা সাদা পায়জামাই ছিল প্রধান, এখন সেখানে এসেছে বৈচিত্র্য। তাঁতের পাঞ্জাবি কিংবা কটনের কুর্তা এখনো জনপ্রিয়, তবে পাশাপাশি ক্যাজুয়াল শার্ট, ফিউশন কাটের কুর্তা-পায়জামা কিংবা স্টাইলিশ জ্যাকেটও জায়গা করে নিয়েছে। আধুনিক পুরুষ পূজার সাজে মানানসই ঘড়ি, চশমা কিংবা হালকা ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ ব্যবহার করতে ভোলেন না। আর শিশুরা তো উৎসবের আসল প্রাণ। তাদের জন্য পূজার কেনাকাটায় আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছোটদের জন্য রঙিন ফ্রক, টপস, জিনস কিংবা কার্টুন প্রিন্টের শার্ট এখন বাজারে সহজলভ্য। অনেকে আবার পরিবারের সঙ্গে মিল রেখে শিশুদের পোশাকেও লাল-সাদা বা বাসন্তী রং বেছে নেন। এতে করে উৎসবের আনন্দে শিশুদের সাজ মিশে যায় পারিবারিক আবহে। তাই পূজা সামনে আসতেই দেশের ফ্যাশন হাউসগুলো নতুন কালেকশন নিয়ে হাজির হয়। একেক বছর তারা আনে একেক রকম বৈচিত্র্য। কখনো শরতের প্রকৃতি থেকে প্রেরণা নিয়ে তৈরি হয় পোশাকের নকশা, কখনো দেবী-দুর্গার শক্তি ও সাহস ফুটিয়ে তোলা হয় মোটিফে। ডিজাইনাররা চেষ্টা করেন নতুনত্ব আনার, যাতে ক্রেতারা প্রতিবারই আলাদা কিছু পান। ফলে পূজার শপিং হয়ে ওঠে শুধু পোশাক কেনা নয়, বরং এক ধরনের অভিজ্ঞতা।
উৎসবের কেনাকাটা মানেই অবশ্যই বাজেটের হিসাব। পরিবারে অনেকে আগেভাগেই শপিংয়ের তালিকা তৈরি করেন। কেউ অনলাইন থেকে অর্ডার করেন, কেউ বা ভিড় সামলিয়ে শোরুমে গিয়ে কিনতে পছন্দ করেন। বাজেট সীমিত হলেও চেষ্টা থাকে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য কিছু না কিছু নতুন কেনা। কারণ সাজপোশাকের এই আনন্দেই পূজার আবহ পূর্ণতা পায়। শারদীয়র সাজপোশাক কেবল ব্যক্তিগত রুচি বা ফ্যাশনের প্রতিফলন নয়, এটি সামাজিক মিলনমেলার অংশও বটে। পূজার ম-পে ভিড় জমে, সেলফি আর গ্রুপ ছবিতে ধরা পড়ে উৎসবের ঝলক। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশী মিলে একে অপরকে নতুন সাজে দেখে আনন্দ ভাগ করে নেয়। কারো হাতে শাড়ির আঁচল, কারো কাঁধে গামছা মিলিয়ে পূজা হয়ে ওঠে এক মহামিলনের উৎসব।
আজকের প্রজন্ম পোশাক নির্বাচনে অনেক বেশি উন্মুক্ত। তারা ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, আবার একইসঙ্গে আধুনিকতার স্পর্শও খোঁজে। তাই শারদীয়র সাজপোশাক এক কথায় বৈচিত্র্যের উৎসব। শাড়ি যেমন তার চিরন্তন জায়গা ধরে রেখেছে, তেমনি ফিউশন ড্রেসও আধুনিক ফ্যাশনের অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে পূজার প্রতিটি দিন ভিন্ন ভিন্ন রঙে, ভিন্ন ভিন্ন সাজে ধরা দেয়, যা প্রতিটি মুহূর্তকে করে তোলে আরও রঙিন।
শারদীয় দুর্গাপূজা কেবল দেবীর বন্দনা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির বৈভব ও ঐতিহ্যেরও প্রতিফলন। এই উৎসব আমাদের শেখায় মিলনের আনন্দ, বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য আর সৌন্দর্যের সাধনা। আর সেই সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দেয় সাজপোশাক, যা শুধু বাহ্যিক রূপকে নয়, ভেতরের আনন্দকেও আলোকিত করে। পূজার কয়েকদিনে তাই প্রতিটি নতুন পোশাক হয়ে ওঠে উৎসবের একেকটি রঙিন প্রতীক, যা বাঙালির জীবনে বারবার ফিরে আসে শরতের আকাশের মতোই চিরন্তন আবহ নিয়ে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন