পোষ্য কোটা নিয়ে বিক্ষোভের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের হাতহাতির পর গত শনিবার রাতভর বিক্ষোভে উত্তাল ছিল রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় (রাবি)। এসব নাটকীয়তার পর অবশেষে গতকাল রোববার রাবির স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার পোষ্য কোটা স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে শিক্ষক ‘লাঞ্ছিতের’ ঘটনায় ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট। গতকাল বিকেল ৫টায় উপাচার্যের বাসভবনে আয়োজিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভা শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় গতকাল এক দিনের কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল আলিম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া পোষ্য কোটা স্থগিত হওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
প্রচার-প্রচারণার শেষ মুহূর্তে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সব ঠিকঠাক থাকলে ২৫ তারিখেই রাকসু নির্বাচন হবে। নির্বাচন পেছানোর কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
গত শনিবার বেলা ৩টার দিকে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন প্রশাসনিক ভবন থেকে বের হলে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তার গাড়ি আটকে দেন। পরে তিনি হেঁটে তার বাসভবনের দিকে যেতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা তার বাসভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে দিলে তিনি জুবেরী ভবনের দিকে যান। তার সঙ্গে প্রক্টর মাহবুবর রহমানও ছিলেন। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে জুবেরী ভবনে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছাত্রদের হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে রাত পৌনে ১০টার দিকে উপ-উপাচার্যসহ অন্য শিক্ষকদের ‘লাঞ্ছিত’ করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল কর্মবিরতির ডাক দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি আবদুল আলিম।
রাত সোয়া ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে স্লোগান দেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শনিবার রাত ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, গতকাল এ নিয়ে জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
অবশেষে গতকাল সিন্ডিকেটের সভায় পোষ্য কোট স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হলো- জুবেরী ভবনে ধস্তাধস্তির ঘটনা তদন্তের জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠন ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ, রাকসু নির্বাচন ২৫ সেপ্টেম্বরেই অনুষ্ঠিত হবে এবং পোষ্য কোটায় ভর্তি কার্যক্রম আপাতত স্থগিত থাকবে। সভা শেষে এ সিদ্ধান্ত জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ।
এদিকে পোষ্য কোটায় ভর্তি স্থগিত ও উপ-উপাচার্য, শিক্ষক ও কর্মকর্তদের লাঞ্চনার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিচারে দাবিতে আজ সোমবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ বিষয়ে অফিসার্স সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের হেনস্তার ঘটনায় জড়িতদের দৃশ্যমান বিচার কার্যকর এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানিক দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কমপ্লিট শাট ডাউন থাকবে’। রাকসু নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ কর্মসূচির কারণে রাকসু পিছিয়ে গেলে সেটা প্রশাসনের ব্যর্থতা, আমাদের নয়।’
অন্যদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামীকাল (আজ) বেলা ১১টায় একটি মানববন্ধন কর্মসূচি করা হবে এবং জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন করা হলো।
সরেজমিনে দেখা যায়, কর্মবিরতি থাকলেও গতকাল সকালে ক্যাম্পাসে সব একাডেমিক ভবনের ফটকের তালা যথারীতি খুলে দেওয়া হয়েছে। খুলেছে প্রশাসন ভবনও। নির্দিষ্ট সময়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিক সময়েই ক্যাম্পাসে আসা শুরু করেন। তবে কর্মবিরতির কারণে বেশির ভাগ বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। পাশাপাশি বিভিন্ন অফিস ও বিভাগের দাপ্তরিক কাজও বন্ধ ছিল। অন্য দিনের তুলনায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনাও অনেক কম দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাফিন বলেন, ‘বেলা ১১টায় একটি কোর্সের ক্লাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভাগে এসে দেখি সব তালাবদ্ধ। এখন ফিরে যাচ্ছি।’ পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী কাওছার আহমেদ বলেন, ‘আজ (গতকাল) আমাদের সেমিস্টার ফাইনালের ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। সকালে বিভাগে এসে জানতে পারি পরীক্ষা হবে না। কালও (আজ) পরীক্ষা আছে। হবে কি না, সিন্ডিকেট সভার পর জানানো হবে’।
রাকসু নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর। আনুষ্ঠানিক নির্বাচনি প্রচারণার বাকি মাত্র তিন দিন। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ক্যাম্পাসে নির্বাচনি আমেজ কমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব বিল্লাহ বলেন, ‘প্রার্থীরা মনে হয় বুঝে গেছে এ পরিস্থিতে নির্বাচন হওয়া কঠিন। কেমন যেন এক নিস্তেজ ভাব তৈরি হয়েছে নির্বাচনি মাঠে।’
নাদিয়া হক মিথি রাকসুতে লড়ছেন ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল থেকে সহ-মহিলাবিষয়ক সম্পাদক পদে। তিনি জানান, ‘কর্মবিরতির জন্য ক্যাম্পাসে আজ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম’।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে একটি জরুরি আলোচনা সভা করেন নির্বাচন কমিশন। সভা শেষে রাকসুর নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমরা ২৫ তারিখেই ভোট করব। নির্বাচন পেছানোর কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন