শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রাফায়েল আহমেদ শামীম

প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৫, ০১:২১ এএম

তরুণদের রাজনীতিবিমুখতা মানে, অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশ

রাফায়েল আহমেদ শামীম

প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৫, ০১:২১ এএম

তরুণদের রাজনীতিবিমুখতা মানে, অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশ

যে সমাজে তরুণরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে সমাজ আসলে তার ভবিষ্যৎকেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। কারণ রাজনীতি কেবল ভোটের প্রতিযোগিতা বা ক্ষমতার খেলা নয়, এটি একটি জাতির চিন্তা, মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নযাত্রার প্রতিচ্ছবি। ইতিহাস সাক্ষী, তরুণরাই সব যুগে পরিবর্তনের অগ্রদূত। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণআন্দোলনÑপ্রতিটি ঐতিহাসিক বাঁকে তরুণদের সাহস, উদ্যম ও নেতৃত্ব ছিল অনিবার্য চালিকাশক্তি। অথচ আজকের বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এক ভয়াবহ বাস্তবতাÑতরুণরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের এই বিমুখতা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, গোটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গভীর স্থবিরতা বিরাজ করছে। একই প্রজন্মের নেতারা দশকের পর দশক নেতৃত্বে আছেন; নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে রাজনীতি এখন অনেক তরুণের কাছে অনুপ্রেরণার ক্ষেত্র নয়, বরং হতাশার প্রতীক। তরুণরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেÑ রাজনীতি মানেই দুর্নীতি, ক্ষমতার লড়াই, ব্যক্তিস্বার্থ, চাঁদাবাজি বা হিংসা। এই মনোভাবের পেছনে শুধু তরুণদের দায় নেই; দায় বর্তায় রাজনৈতিক দলের দিকেও। তারা তরুণদের রাজনীতিতে যুক্ত করার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় রাজনীতিতে নতুনদের জায়গা নেই, দলগুলোতে নেতৃত্বের উত্তরাধিকার এখন পরিবারকেন্দ্রিক বা অর্থনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলাফলÑএক প্রজন্ম ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার, চাকরি বা অনলাইন জগতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।

আজকের তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষই ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে। এরা যদি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে না আসে, তবে দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে না। তখন রাজনীতি থাকবে কিছু অভিজ্ঞ কিন্তু আত্মতুষ্ট নেতার হাতে, যারা হয়তো বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই জন্ম নেয় প্রজন্মের মধ্যে আস্থাহীনতা, সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। যে দেশে তরুণরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকে, সে দেশে গণতন্ত্র কেবল নামেই টিকে থাকে, প্রাণ হারায় এর অন্তর্নিহিত শক্তিÑ‘জনসম্পৃক্ততা’।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের অনুপস্থিতি শুধু সংসদ বা দলীয় পদে নয়, বরং রাজনৈতিক চিন্তা ও নেতৃত্বের চর্চাতেও দৃশ্যমান। তরুণদের অনেকেই আজ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, চায়ের দোকান কিংবা অনলাইন ফোরামে রাজনীতি এখন একধরনের বিতর্কিত বিষয়। কেউ বললেÑ‘রাজনীতি করি’, সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ বা নেতিবাচক মন্তব্য জাগে। অথচ রাজনীতি মানে তো সমাজ গঠন, মানুষের সমস্যা সমাধান, নেতৃত্বের চর্চা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনীতিকে এখন আমরা অপরাধ, সুবিধাবাদ ও দখলবাজির সমার্থক করে ফেলেছি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল তরুণদের যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে যারা অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, তাদের গড় বয়স ছিল বিশ থেকে তেইশ। স্বাধীনতার পরেও দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল নির্ণায়ক। অথচ আজ সেই ক্যাম্পাসগুলোই হয়ে গেছে রাজনৈতিক সহিংসতার কেন্দ্র। ছাত্র সংগঠনগুলোর বড় অংশ এখন দলীয় ক্ষমতার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ; আদর্শ বা শিক্ষার চর্চা নেই, আছে শুধু লাঠিয়াল বাহিনী ও টেন্ডার বাণিজ্য। তরুণরা যে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তার অন্যতম কারণ এটাই। তারা আর বিশ্বাস করে না যে রাজনীতি মানুষের কল্যাণে কাজ করে; বরং মনে করে রাজনীতি মানেই ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম।

তরুণদের রাজনীতিবিমুখতার আরেকটি বড় কারণÑবিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের সংকট। তরুণরা এখন তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ, তারা দেশ-বিদেশের রাজনীতির খবর, মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা সবই জানে। তারা চায় আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব, সৎ রাজনীতিক, উন্নয়নের বাস্তব পরিকল্পনা। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা দেখতে পায় দলীয় স্বার্থ, পারিবারিক প্রভাব ও অর্থের দাপট। এর ফলে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তারা রাজনীতিকে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে নয়, বরং একপ্রকার ‘অপরিচ্ছন্ন পেশা’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ।

রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের সীমাবদ্ধতায় তরুণদের হারাচ্ছে। তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে বা নেতৃত্ব গঠনে দলীয় উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ তরুণদের রাজনীতিতে যুক্ত করতে হলে প্রয়োজন সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টাÑযেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ, ও দলীয় কাঠামোয় তরুণদের জন্য নির্দিষ্ট কোটার ব্যবস্থা। অনেক উন্নত দেশে যুব পার্লামেন্ট, যুব কাউন্সিল বা যুব নীতি তৈরি করে তরুণদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশেও সেই সুযোগ তৈরি করা জরুরি।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে তরুণদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল, তা দেখিয়েছেÑতারা রাজনীতিতে আগ্রহ হারালেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এখনো সোচ্চার হতে জানে। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, তরুণরা রাজনীতি থেকে দূরে নয়; বরং তারা চায় নতুন ধারা, নতুন নেতৃত্ব, সৎ ও আধুনিক রাজনীতি। ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের যুগে তরুণরা মতামত প্রকাশের নতুন মঞ্চ পেয়েছে। তারা অনলাইনে সচেতনতা গড়ে তুলছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে, বিকল্প চিন্তা ছড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনলাইন আন্দোলন যদি মাঠের বাস্তব রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হয়, তাহলে তা হবে ক্ষণস্থায়ী। পরিবর্তন আনতে হলে রাজনীতি ও সংগঠিত নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই কাজ করতে হবে।

রাজনীতি থেকে বিমুখ প্রজন্ম কোনো সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে না। ব্যক্তিগত সফলতা, বিদেশে পড়াশোনা বা করপোরেট চাকরিÑএসব সমাজের উন্নয়ন ঘটায় বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন করে না। রাষ্ট্রের নীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, কর্মসংস্থানÑসব কিছুর মূলে রাজনীতি। তাই রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানে নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। তরুণদের বোঝা উচিতÑ রাজনীতি তাদের বেঁচে থাকার প্রতিদিনের বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত; এটি তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ।

রাজনীতিবিমুখতার ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা খুব দ্রুত ভরে নেয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। যখন সৎ, মেধাবী তরুণরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকে, তখন অসৎ, সুবিধাবাদী ও অপরাধপ্রবণরা সেই জায়গা দখল করে নেয়। ফলাফলÑ রাজনীতির মান পড়ে যায়, সমাজে দুর্নীতি বাড়ে, নীতি ও মূল্যবোধ ধ্বংস হয়। তাই তরুণদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার মানে শুধু নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া।

রাজনীতি হতে হবে ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যম। তরুণরা যদি চায় একটি স্বপ্নময়, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ, তবে তাদের রাজনীতিতে যুক্ত হতে হবে। তারা পারে নতুন চিন্তা আনতে, প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে, পরিবেশ ও নারী অধিকার নিয়ে নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে। তরুণ নেতৃত্বই পারে জাতিকে নতুন দিশা দিতে। ইতিহাসে যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহিদ জিয়াউর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদÑসবাই তরুণ বয়সেই নেতৃত্বের যাত্রা শুরু করেছিলেন। আজও সেই অনুপ্রেরণা দরকার।

এখানে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে। তরুণদের রাজনীতিতে আগ্রহী করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় নেতৃত্ব ও নাগরিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাজনীতি মানেই সেবা’Ñএই ধারণা জাগাতে হবে। দলীয় প্রভাবমুক্ত ছাত্র-রাজনীতি পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে তা হয় নীতি, আদর্শ ও জনসেবার প্ল্যাটফর্ম। মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকেও তরুণদের ইতিবাচক রাজনীতি চর্চায় উৎসাহিত করতে হবে।

একটি সমাজ তখনই টেকসই উন্নয়নের পথে এগোয়, যখন তার তরুণরা দায়িত্ববান, সচেতন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতিতে যুক্ত থাকে। আজকের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তিতে বিশ্ব জয় করছে, স্টার্টআপ ও উদ্ভাবনে সফল হচ্ছে, কিন্তু তাদের যদি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে সেই সাফল্যও টিকবে না। কারণ রাষ্ট্রের নীতিই নির্ধারণ করে তারা কী সুযোগ পাবে, কোন পরিবেশে বাঁচবে। তাই রাজনীতি এড়িয়ে নয়, রাজনীতিকে পরিবর্তনের অস্ত্র বানিয়ে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।

তরুণরা যদি রাজনীতিতে নেতৃত্ব নেয়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা তৈরি হবেÑযেখানে থাকবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মানবিক মূল্যবোধ। তারা পারে দলীয় বিভাজনের দেয়াল ভেঙে এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে, যেখানে রাজনীতি মানে হবে সেবার ব্রত, শোষণ নয়। রাজনীতি হবে আদর্শ, নৈতিকতা ও উন্নয়নের সমন্বিত ক্ষেত্র। তরুণদের মধ্যে সেই আগুন এখনো নিভে যায়নি; প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগের।

শেষ পর্যন্ত, প্রশ্ন একটাই আমরা কি চাই আমাদের রাজনীতি আগের মতো একই মুখ, একই পদ্ধতি, একই ব্যর্থতা নিয়ে চলুক, নাকি আমরা চাই নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে আলোকিত, জবাবদিহিমূলক ও আধুনিক বাংলাদেশ? যদি আমরা সত্যিই পরিবর্তন চাই, তবে তরুণদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা নয়, বরং তাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। কারণ তরুণরাই জাতির প্রাণ, আর তাদের রাজনীতিবিমুখতা মানে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া।

তরুণদের উদ্দেশে তাই একটাই আহ্বান রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিও না। এটি তোমার অধিকার, তোমার দায়িত্ব, তোমার ভবিষ্যৎ। তোমরা যদি সৎ, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক হয়ে রাজনীতিতে আস, তাহলে এই মাটিতেই আবার জন্ম নেবে ন্যায়, উন্নয়ন ও আলোর রাজনীতি। সময় এসেছে তরুণদের হাতেই রাজনীতির হাল তুলে দেওয়ার, কারণ দেশের ভবিষ্যৎ তাদেরই হাতে লেখা হবে।

রাফায়েল আহমেদ শামীম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ও কলাম লেখক

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!